বিশেষ প্রতিনিধি :: | বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে অবাধে বেড়জাল ও নিষিদ্ধ জাল দিয়ে চলছে মাছ নিধন। সাম্প্রতি ভয়াবহ বন্যার কারণে হাওরে পানি থাকায় এবার প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার বেড়েছে। তাই একশ্রেণীর অসাধু লোকজন অবৈধভাবে জাল দিয়ে মাছ শিকারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এতে হুমকিতে রয়েছে হাওরের মৎস্যসম্পদ, জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এবার হাওরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে পর্যাপ্ত পানি থাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকের পুকুর ভেঙে তাদের চাষকৃত মাছ এবং কুশিয়ারা নদীর জলস্রোত হয়ে দেশি-বিদেশী নানান প্রজাতির মাছের প্রজনন হাওরে বেড়েছে। তাই প্রতিদিন স্থানীয় অনেক লোকজন অবৈধভাবে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ এসব লোকজন আহরণ করে দেশে বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করতে দেখা যায়। এতে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা যায়,প্রায় ১৫-২০ বছর আগেও হাকালুকি হাওরে ১১০ প্রজাতিরও বেশি দেশীয় মাছ ছিল। যা এখন ৫০ প্রজাতির নিচে নেমে এসেছে। অবাধে মাছ নিধনের ফলে হাওর থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে গাঙ মাগুর, রিটা, নানিদ, বাঘাইড়, চিতল, রানী মাছসহ কয়েক প্রজাতির সুস্বাদু মাছ।
এ ছাড়া হাওরের মাখনা, পদ্ম, সিঙরা, শাপলা, বনতুলসী, নলখাগড়া, হেলেঞ্চাসহ শতাধিক প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ছিল। এসব উদ্ভিদও এখন বিলুপ্তপ্রায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও হাওরের প্রতিবেশ নিয়ে কার্যক্রম চালানো সংস্থার সূত্রে জানা যায়, বর্ষাকালে প্রতিদিন বেড়জাল ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে অবাধে মাছ শিকার করছে স্থানীয়রা। বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দলবদ্ধভাবে জেলেরা বড় নৌকাযোগে মাছ শিকার করেন এবং হাওরের পানিতে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দুই পাশে বাঁশের খুটি দিয়ে বেধে (পাতিয়ে) রাখলে সেই জালগুলোতে মাছ আটকিয়ে শিকার করা হয়। আগে বেড়াজালের দৈর্ঘ্য এক থেকে দেড় হাজার ফুট আর ব্যাস (জালের ছিদ্র) বড় ছিল। এখন জেলেদের ব্যবহৃত জালের দৈর্ঘ্য তিন-চার হাজার ফুট এবং ব্যাস ছোট। এ কারণে বড় মাছের সঙ্গে ধরা পড়ছে পোনা মাছও। এসব জালে হাওরের জলজ উদ্ভিদগুলো পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
হাওর তীরের কুলাউড়ার সাদিপুর, জুড়ীর শাহপুর, বেলাগাঁও, বড়লেখার সুজানগরের কানুনগো বাজারে প্রায় পাঁচ হাজার মৎস্যজীবী পরিবারের বসবাস। হাওর থেকে মাছ শিকার করে এসব মৎস্যজীবী তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্ষাকালে হাওরজুড়ে পানি থাকে চার-পাঁচ মাস। এ সময় জেলেরা বড় বেড়জাল ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে হাওরের নাগুয়া, বেড়কুরি, ফুটবিল, চকিয়া বিল, হাওরখাল, চাতলাবিল, কাংলি, গোবরকুড়ি, ধলিয়া বিল, হাল্লা, জল্লার, পলোভাঙ্গা, কুটাউরাসহ অর্ধশতাধিক বিল এলাকায় মাছ শিকার করেন।
জুড়ী উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা পরিবেশকর্মী খোরশেদ আলম বলেন, ‘নানা দূষণে হাওরের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে রয়েছে। হাকালুকিতে দেশীয় মাছের প্রজননকালেও অবাধে মাছ শিকার হয়। এতে মা মাছ ও পোনা মাছ ধরা পড়ায় মৎস্যসম্পদ হুমকিতে। হাওরের জলজ উদ্ভিদগুলো প্রাণ হারাচ্ছে। হাওরের প্রতিবেশ রক্ষায় পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। ’
বেসরকারি সংস্থা সিএনআরএসের আওতায় হাকালুকির প্রতিবেশ প্রকল্পের সাইট কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান জানান, আমাদের প্রযেক্টের কার্যক্রম প্রায় ৫-৬ বছর বন্ধ ছিলো। যার কারণে স্থানীয়দের নিয়ে মাছ নিধন সম্পর্কে কোনো বৈঠক করতে পারিনি। তবে আমরা শীঘ্রই স্থানীয়দের নিয়ে সচেতনমূলক বৈঠক করে নতুন কমটি গঠন করবো। এতে অবাধে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ নিধন বন্ধ হবে। ১৫ বছর আগেও হাওরে ২৫টিরও বেশি অভয়াশ্রম ছিল। বর্তমানে অভয়াশ্রমের সংখ্যা মাত্র ১১টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটিতে মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। অবাধে বেড়জাল ব্যবহারে হাওরের জলজ উদ্ভিদ বিনষ্ট হচ্ছে। এতে মাছের খাবার সংকটও দেখা দিচ্ছে। এরই মধ্যে হাওরের সুস্বাদু দেশীয় বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আবু মাসুদ বলেন, ‘হাকালুকির কুলাউড়ার অংশের বিভিন্ন স্থানে আমরা এরই মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে ২০ হাজার ফুট নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করেছি। এ ছাড়া ১২ জেলেকে ২২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ’
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে তিন দিন পর পর হাকালুকির কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা অংশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বড়লেখা অংশে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও বেড়জাল জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে।
Posted ৯:৩১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.