শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিকৃতি

চিররঞ্জন সরকার | সোমবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট  

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিকৃতি

চিররঞ্জন সরকার

মানুষের মধ্যে সুস্থ, স্বাভাবিক ইতিবাচক ভাবনা-চিন্তা-আচরণ যেন একটু একটু করে লোপ পাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিকৃতি ক্রমেই বাড়ছে। আর এই বিকৃতি প্রকাশের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক মাধ্যমের আনাচে-কানাচে এখন বিকৃত চিন্তা, যৌন ইঙ্গিতমূলক মন্তব্যের ছড়াছড়ি। রাজনৈতিক খবর, সেলিব্রিটির জীবনের ছবি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস বিষয় যা-ই হোক না কেন, কিছু মানুষ যৌন মন্তব্যের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। কোনও খবর বা কারও বক্তব্য নিয়ে একমত না-ই হতে পারি। সেক্ষেত্রে যুক্তিপূর্ণ আপত্তি উঠতেই পারে। কিন্তু তা হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কী নিয়ে পোস্ট, কী তার বক্তব্য, সে সব কিছু তলিয়ে পড়বার আগেই চার অক্ষর লিপিবদ্ধ হচ্ছে। যে ভাষা সচরাচর মুখে আনা যায় না, সেই ভাষার উদগ্র উচ্চারণ দেখা যাচ্ছে। সদ্য গালাগাল শেখার পর কেউ কেউ অকারণে সেগুলো আওড়াতে থাকে। এক্ষেত্রেও যৌন ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যের তেমনই এলোপাতাড়ি প্রয়োগ নজরে আসছে।
কেউ আবার যেখানে পারছে, হা-হা হাসির ইমোজি দিয়ে আসছে। আফগানিস্তানে তালেবান আক্রমণের ভিডিও থেকে শুরু করে করোনা সংক্রমণের গ্রাফ সব কিছুতেই হাসি! যেন সমস্তটাই হাসির রসদ। বলা বাহুল্য, এ হাসি আনন্দের নয়। এ-ও আসলে অন্যকে হেয় করার সহজতম সঙ্কেত। যে কোনো বিষয়কে লঘু করার অমোঘ চিহ্ন। এ হাসি প্রাসঙ্গিকতার চৌহদ্দি ছাপিয়ে যেখানে সেখানে উথলে উঠছে। এই হাসির মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ নেই। এমনকি, এই অতি সক্রিয় যৌনতার মধ্যেও না আছে আবেদন, না আছে শিহরণ। বরং একধরনের হিংস্রতা আছে।
যে দুটি তাগিদের অকপট বহিঃপ্রকাশ সমাজে নিষিদ্ধ, তার একটি হলো রাগ। অন্যটি যৌনতা। সমাজের নিয়ম রেওয়াজের চাপে রাগ এবং যৌনতাকে আমরা ঘষেমেজে প্রকাশ করতে শিখি। কিন্তু তার আদিম অবাধ দাঁত-নখ আমাদের অনেকের অবচেতনে নিশপিশ করে। নিরাপদ নিষ্ক্রমণের সুযোগ খোঁজে। কখনো সে গণপিটুনির ইন্ধন হয়ে অচেনা ব্যক্তিকে পিটিয়ে আসে। কখনো অনেকের একজন হয়ে বাসের টায়ার পোড়ায়। কখনো ভিড় ট্রেনে জনৈক হাত হয়ে নারীকে যৌন হয়রানি করে। কখনো রাতের আড়ালে সদ্য রং-করা বাড়ির দেয়াল খুঁচিয়ে দেয়। সমাজমাধ্যমেও সেই রাগ সেই যৌনতা নিজের অবস্থান নিশ্চিত করছে। উটকো নামের প্রোফাইল খুলে কখনো অন্যের দেয়ালে রুচিবিগর্হিত ভাষায় মন্তব্য করছে। কখনো সেলিব্রিটির ছবির নিচে রগরগে যৌন প্রস্তাব লিখে আসছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহায়ক ওই ‘অ্যানোনিমিটি’। ওই আড়াল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের নামেও যারা অন্যকে আক্রমণ করছে, তারাও একটা দূরত্বের আড়াল পাচ্ছে। প্রোফাইল লক করে বজ্জাতি করে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাকে আক্রমণ করছি, সে উজান বেয়ে আইপি অ্যাড্রেস খুঁজতে যাচ্ছে না। ক’জনই বা থানা-পুলিশের ঝামেলা নেবে। কতবার নেবে। অতএব এই মওকায় আমরা অন্যের প্রোফাইলে আমার পুষে রাখা হিংস্রতা গুঁজে দিয়ে আসছি।
বহু হিংস্রতার মূলে আমাদের দীর্ঘকালের জমা ক্ষোভ থাকতে পারে। নিত্যদিনের অসহায়তা, অন্যায়ের প্রতিবাদ গিলে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আমাদের মধ্যে গুমরে থাকে। ক্ষমতার সৌধের দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে ফেলা দীর্ঘশ্বাস আমাদের দম আটকে দেয়। কত ঝগড়া নেহাত সাহসে কুলোয়নি বলে করা হয় না। অন্যের কাছে হেয় বোধ করার অপমান আমরা বহন করে চলি। অন্যের ভালো দেখে জ্বলে-ওঠা ঈর্ষা আমাদের অশান্ত করে। সেই সব তিতকুটে বাসি আবেগ ফাঁকফোকর খোঁজে। এমন পরিসর খোঁজে, যেখানে উন্মুক্ত হলেও সরাসরি পাল্টা আঘাত আসার সুযোগ কম। এবং তেমন বেকায়দায় পড়লে কেটে পড়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সেই সব আবেগের আবর্জনা ধারণ করে।
আমরা বিভিন্ন প্রোফাইল বানিয়ে ফেলি। একটি রিপোর্ট করা হলে আরেকটি উপস্থিত হয়। নিজের মধ্যে এতদিন যে সব হজম-অযোগ্য আবেগ রেখে ঢেকে চলছিলাম, তা অন্যের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকি। আমরা সাময়িক আঙুলের আরাম বুঝে নিই। কিন্তু তার পরিণাম নিয়ে ভাবিত হই না। পরিণাম নিয়ে ভাবলে অন্যের অসম্মতি, অমর্যাদা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। আমাদের কুৎসিত ব্যক্তি আক্রমণের ঠেলায় অন্যের মন বিধ্বস্ত হলেও আমরা থামি না। সাইবার বুলিংয়ে সেদ্ধ হয়ে অন্য সব ব্যর্থতা পুষিয়ে নিতে চাই।
যে সব মানুষ পরিচিত, সম্মানিত, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল, তারাই সহজ টার্গেট। তাদের হেয় করে, অপমান করে, যৌন-কটাক্ষে হেনস্থা করে অনেকের দিন শুরু হয়। যারা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাদের ডিজিটাল আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে হয়তো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সম্ভাবনা থাকে। এমনি হয়তো তিনি ফিরেও দেখতেন না। প্রবল অসম্মানিত হয়ে যদি ফিরে দেখেন? যদি উত্তর দেন? ওটুকুতেও অনেকে গুরুত্ব পায়। অনেকে আবার সাহস এবং ক্ষমতা জাহির করার জন্য একটু ঘুরপথ নেয়। যাকে সবাই মূল্য দেয়, শ্রদ্ধা করে আমি তার বাপবাপান্ত করতে পারি! পারি, মানেই আমি আরও বড় ব্যাপার। অনেক সময় গভীর হীনম্মন্যতা থেকেও কেউ কেউ অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় প্রমাণ করতে চায়।
কোনো নামি প্রতিষ্ঠানকে পায়ে পা দিয়ে গালাগাল দেওয়ার মধ্যেও একই মানসিকতা লুকিয়ে রয়েছে। প্রতিপত্তি বা ক্ষমতাসম্পন্ন প্রোফাইলে ঢুকে গাল দিতে পারলে নিজেকে সাময়িকভাবে ক্ষমতাশালী মনে হয়। কেউ কেউ আবার বাগ্বিতণ্ডায় জড়াতে পারলে একটা ‘কিক’ পায়। না হলে জীবন মিইয়ে-যাওয়া বিস্কুট হয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ সংলাপ শুরুই হয় ‘মানতে পারলাম না’ দিয়ে। গোটা বিষয়টা বিচার না করে স্রেফ বিতর্কে যাওয়ার হিড়িকে তারা জোর করে মাঠে নামে। কিছুক্ষণ পর যুক্তিতে টান পড়ে। তখন আবারও তাদের ভরসা সেই ব্যক্তি আক্রমণ।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ত্রুটিমুক্ত হবেই এমন নয়। কোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা, নিন্দা, ব্যঙ্গ হতেই পারে। কিন্তু কী যুক্তি প্রয়োগ করছি, কী ভাষায় প্রতিবাদ করছি, সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার উদ্দেশ্য অমুক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অসম্মান করা নয়। তার কাজ বা বক্তব্যকে প্রশ্ন করা। সেখানে যুক্তি এবং পালটা যুক্তি আসতেই পারে। মতান্তর থাকতে পারে। কিন্তু হিংস্র ভাষায় দেয়াল দূষণ করছি কেন? এমন অসংযত বে-লাগাম কটূক্তির প্রতি আমাদের ঝোঁক কেন? আসলে যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করতে হলে চিন্তার যে প্রসারের প্রয়োজন, ভাবনার যে শ্রমের প্রয়োজন, তা ক্রমশ বিরল। আমাদের অধিকাংশ যুক্তি অতি সাধারণীকরণ দোষে দুষ্ট। একজন ব্যক্তিকে তার ভিন্নতায় স্বকীয়তায় দেখার চেষ্টা আমরা করি না। ‘ডাক্তার মানেই শুধু ব্যবসা বোঝে’, ‘মিডিয়া মানেই পা-চাটা’, ‘রাজনীতি করে মানেই দুর্নীতিগ্রস্ত’, এমন সব একরৈখিক অতিসরল লেন্সে ফেলে আমরা অন্যকে দেখি। এবং দেখ-না-দেখ ফতোয়া জারি করি। অগভীর এবং একপেশে নিদান দেওয়ার জন্য মাথা খাটাতে হয় না। অন্যেরা যখন ট্রল করছে, সেখানে আমারও অশ্রাব্য গালাগাল দিব্যি মান্যতা পেয়ে যায়। কী নিয়ে ট্রলিং, আদৌ সেটি নিন্দনীয় কি না, অত ভাববার মতো মেধা বা সময় আমরা ব্যয় করি না। ট্রলিংয়ের সংস্কৃতি আমাদের চিন্তার দৈন্যকে প্রশ্রয় দেয়। স্বীকৃতি দেয়।
‘ডিজিটাল-ডিসইনহিবিশন’ নিয়ে মনোবিদরা গবেষণা করছেন। যে ভাষা আমাদের রুচি-শিক্ষা-পরিচিতির সঙ্গে খাপ খায় না, ‘জনৈক’ সেজে সে ভাষা উচ্চারণ করার তাগিদ বাড়ছে। ভুয়া প্রোফাইল একটা ঢাল। নাম-ধাম-কর্ম-পরিচিতি অক্ষত রেখে কদর্য ভাষায় আক্রমণ চালাতে এটি সাহায্য করে। ঘোলাটে নামাঙ্কিত প্রোফাইল তো আসলে আমাদেরই আরেকটা সত্তা। যে সত্তা অপরিশুদ্ধ গালাগাল লিখে আনন্দ পায়। যে সত্তা নির্লজ্জ হতে চায়। আগেও চেয়েছে। অন্যের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে পারেনি। এখানে কেউ জানতেও পারছে না এই উদ্ভট নামের প্রোফাইলটি আসলে কারও কাকু, কারও বান্ধবী, কারও শিক্ষক, কারও সহকর্মী, কারও প্রতিবেশী..।
‘তুমি অমুক হয়ে এটা লিখতে পারলে’ কথাটা শুনতে হচ্ছে না। কারণ, ‘অমুক’ হয়ে লিখছি না। সব সামাজিকতার পাঠ, সভ্য-ভদ্র আচরণ যেন শুধু অন্যের সামনেই নিপাট। যথাযথ। অন্যের কাছে আত্মপরিচয় আড়াল করে ফেলতে পারলে আর সেন্সর করতে হয় না। আত্মগোপনের সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে আমরা অনেকেই আত্মনিয়ন্ত্রণের আস্তরণ খুলে ফেলছি। অনেকে বলছেন এটি ‘ডিজিটাল ক্যাথারসিস’। আমরা ‘নীরব আশা’, ‘অচেনা পথিক’, টিমটিমে সজারু’, ‘কানকাটা কলিকাল’ এসব আজগুবি প্রোফাইল খুলে এমন সব মন্তব্য করে আসছি, যা নিজের চোখেও বেমানান।
যা নিজেও সামলাতে পারছি না, সেই হিংস্রতা এবং যৌনতা অন্যের দেয়ালে চালান করলেই কি তার ভার কমছে? নাম-বেনামের চক্করে নিজের প্রিয় সত্তাকে নিজের কাছেই ব্লক করে ফেলছি না তো? নাকি এই বিকৃতিই এখন আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য?
লেখক : লেখক ও কলামনিস্ট
chiros234@gmail.com

উৎস : দেশ রূপান্তর


Facebook Comments Box


Comments

comments

advertisement

Posted ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২১

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত