মঙ্গলবার ১৯ মার্চ, ২০২৪ | ৫ চৈত্র, ১৪৩০

মানুষ আবার ফিরে যাক জীবনবোধের কাছে

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী | শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট  

মানুষ আবার ফিরে যাক জীবনবোধের কাছে

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

-সংগৃহীত

পৃথিবীতে মানুষ সব সময় বড় বড় সুখ খুঁজে। এই বড় বড় সুখ খুঁজতে গিয়ে মানুষ ছোট ছোট এমন অনেক সুখকে হারায়, যাদের মূল্য বড় বড় সুখের চেয়ে অনেক বেশি। একবার চোখটা বন্ধ করে নিজের মতো করে ভাবুন তো, আপনি কী কী হারিয়েছেন। একটু ভাবুন, ধ্যানমগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই, যে মনুষ্যত্বটা মরে গেছে সেটাকে জীবনবোধের গভীর থেকে হাত দিয়ে বের করে এনে ভাবুন। বোধ হয় সে মনুষ্যত্বটাতে মরিচা পড়ছে। আগাছা পরগাছাও জন্মেছে। তার পরও চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবুন। কারণ অনেক সময় আলো মানুষকে যা দেখাতে পারে না, অন্ধকার চোখ তা দেখিয়ে দেয়।
আগের দিনে সিনেমা হলে ফিল্মের ভেতরের ছবিকে পর্দায় জীবন্ত করতে সবকিছু অন্ধকার করে ফিল্ম আর পর্দার মধ্যে আলোর যোগসূত্র তৈরি করা হতো। চোখ বন্ধ করে মনের সঙ্গে আপনার ফেলে আসা দিনগুলোর যোগসূত্র তৈরির কথা বলছি।
মনে পড়ছে, একদিন আপনি সংসারের জন্য টাকা উপার্জন করতেন। খুব বেশি বেতন না আপনার। তার পরও মা-বাবা, ছেলেমেয়ে আর বউকে নিয়ে টমটমে উঠেছেন, সবাই মিলে সামাজিক ধাঁচের একটা সিনেমা দেখে চোখের পানি নাকের পানি এক করেছেন। এরপর সস্তা হোটেলে আয়েশ করে বসে ডাল-ভাত-ভর্তা খেয়েও সুখের ঢেকুর তুলেছেন। মেলায় মেলায় ঘুরে পরিবারসহ যাত্রা দেখেছেন, সার্কাস দেখেছেন, পুতুলনাচ দেখেছেন, এটা-ওটা কত কিছু কিনেছেন। সোহাগী বউয়ের জন্য এক পয়সার আলতাও কিনেছেন। আমোদিত হয়েছেন, আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। বউ আপনাকে আদর করে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়েছে, যেন আপনার চান্দের মতো চেহারাটা আরও জ্বলজ্বল করে। আর আপনি একটু একটু করে কষ্টের টাকা জমিয়ে বউয়ের জন্য লাল শাড়ি কিনে এনেছেন। হয়তো সেটা বেনারসি, জামদানির মতো এত মূল্যবান ছিল না কিন্তু সেটাতে ভালোবাসাটা ছিল অমূল্য। আপনি অফিস যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েরা আপনাকে আদর করে জাপটে ধরেছে, না বাবা, আমাদের সঙ্গে থাকবে, অফিসে যেতে দেব না। বাবা-ছেলেমেয়েদের সে কী মান-অভিমানের খেলা চলেছে! আপনিও তাদের সময়ে অসময়ে কাঁধে তুলেছেন, কোলে তুলে আদর করেছেন। কখনো ঘোড়া হয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে ছেলেমেয়েদের মায়াবী মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে রিকশায় উঠে ফুরফুরে মেজাজে সারা শহর আনন্দে মাতিয়েছেন। নিজের মা-বাবার সঙ্গে প্রতিদিন গল্প করেছেন, তাদের যত্নআত্তি করেছেন।
অথচ সেই আপনি আজ কত পালটে গেছেন। একটা সরল জীবন ছেড়ে জটিল জীবন বেছে নিয়েছেন। সংসারের টানাপড়েনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে ভেবেছেন টাকার চেয়ে আর বড় কী হতে পারে। প্রথমটায় ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য টাকার পেছনে দৌড়েছেন। আর এখন নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য টাকার পেছনে দৌড়ান। যেদিন আপনি টাকাকে বড় ভেবেছেন, সেদিন আপনার মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটেছে। টাকা বেড়েছে অনেক, তার সঙ্গে সম্পর্কগুলোর দূরত্বও বেড়েছে অনেক। টাকার বিনিময়ে মানমর্যাদা বেড়েছে অনেক, বড় বড় সোসাইটিতে মান্যগণ্য মানুষ হিসেবে আপনার জয়জয়াকার হয়েছে অনেক, অথচ আপনি পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। আপনার ভিতর যে মানুষটাকে দেখে পরিবারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটে উঠত, সেখানে এখন হাহাকার, আর্তনাদ আর বিষণ্ণতা। এখন খুব দামি মডেলের গাড়ি হয়েছে আপনার, সেখানে প্রকৃতির বাতাস নেই, আছে দম বন্ধ হওয়া এসির উটকো গন্ধ। একবার ভেবে দেখুন তো জীবনের মিথ্যে মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে কতদিন আপনার প্রিয়তমার মুখটা দেখেননি, কতদিন আপনার আদরের সন্তানদের মায়াবী মুখটা ভালো করে দেখেননি, কতদিন আপনার বৃদ্ধ মা-বাবার খবর নেননি। কতদিন তাদের সঙ্গে একটু ভালো করে কথা বলেননি। সুটকেসের পর সুটকেস ভরে ভরে টাকা দিয়ে সব তো কিনেছেন, অথচ পরিবারের অতি আপনজনদের ক্রমাগত হারিয়েছেন। রঙ্গলীলায় মেতেছেন, শরাবখানায় ডুবেছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, এমনকিছু নেই যা করেননি। এখন তো কলকাঠিও নাড়ান অথচ পথেঘাটে প্রতিদিন জীবনকে নির্মমভাবে হারান। একদিন বলতেন সব তো পরিবারের জন্যই করছি আর এখন কিছুই বলতে পারেন না।
অনেক বড় হতে গিয়ে আপনি অনেক ছোট হয়ে গেছেন। না আছে আপনার অস্তিত্ব, না আছে আপনার পরিবার, না আছে সুখ, না আছে দুঃখ। না আছে হাসি, না আছে কান্না। সব এখন অন্তঃসারশূন্য।
আচ্ছা, জীবন কি আবার উলটপালট করা যায়। আবার কি ফিরে যাওয়া যায় সেই ফেলে আসা জীবনে, ফেলে আসা সাধারণ দিনগুলির কাছে, যেখানে পরিবারের সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্তই ছিল অসাধারণ, কিংবদন্তির মতো, পরশপাথরের মতো। প্রতিটা সময়ের জীবনের স্পন্দন ছিল এক একটা অনিন্দ্য সুখ। এক একটা সম্পর্কের গজিয়ে ওঠা নতুন নতুন আনন্দের শিকড়।
কে জানে? সেখানে ফিরে যাওয়া যায় কি না? কিংবা সেখান থেকে যারা একবার অন্য পৃথিবীতে চলে যায় তারা আবার ফিরে আসতে পারে কি না।
তার পরও টাইম মেশিনটা দুরবিন দিয়ে খুঁজছি। যদি সেটা পাই, তবে হয়তো সেটা আমি তাদেরকে দিতে চাই, যারা আবার পুরোনো পৃথিবীতে ফিরে যেতে চায়। আপনজনদের প্রাণের দোলায় আবেগমথিত হতে চায়। যারা অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আবার যাপিত জীবনকে ফিরে পেতে চায়। যাদের কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে আবার জীবনের ছোট ছোট সুখগুলো মুখ্য হয়ে উঠবে। যেখানে সত্য আরো সুন্দরতম হয়ে উঠবে। চাঁদের মতো, সূর্যের মতো, তারার মতো।
সুতোটাকে নাটাইয়ে জড়িয়ে রেখে আমি ঘুড়িকে আমার ক্রীতদাস করেছিলাম। এখন ঘুড়িদের কষ্ট বুঝি তাই আর ঘুড়ি উড়াই না।
এখানে ঘুড়ি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। খুব শৈশবে আমরা সুতো আর নাটাই হাতে নিয়ে রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়াই। অবুঝ মন তখন বোঝে না, ঘুড়ি প্রাণহীন হলেও আমাদের হাতের নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না। হয়তো লাল নীল সবুজ ঘুড়ি নিজেদের মতো করে উড়তে উড়তে দিগন্তে হারিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা তা হতে দিই না। কখনো বুঝে কখনো না বুঝে।
স্বাধীনতা সবার স্বপ্ন আর বিশ্বাসের মধ্যে সামগ্রিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। পরাধীনতা কারো কাম্য নয়। পরাধীনতার চেয়ে আর বড়ো কোনো গ্লানি নেই। আমাদের নিজেদের স্বকীয়তা, ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্রতা যখন অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন আর নিজের মেরুদণ্ডটা থাকে না।
আমরা মানুষ। কারো খেলার পুতুল নই। কিন্তু দুর্নীতি কিংবা মাদক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। টাকা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রঙ্গশালার রঙ্গলীলা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে এমন অনেক কিছু, খুব সূক্ষ্মভাবে, সুকৌশলে। যেগুলো মানুষ জানে বোঝে, হয়তো সেগুলোর দ্বারা আক্রান্তও হয় কখনো কখনো। তার পরও মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নেয়, গা বাঁচিয়ে চলে।
মাথা উঁচু করে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার নৈতিকতা মানুষ হারিয়েছে মানুষ। ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলার মানুষদের আর দেখছি না। আমি কাউকে এ জন্য দোষারোপ করছি না। কারণ এ দায় মানুষের, এ দায় সামষ্টিক নেতিবাচক চিন্তার। মানবিক রূপ দানবিক হয়ে পচন ধরিয়েছে মানুষের মনে, মানুষের মনুষ্যত্বে।
মানুষ মানুষের ওপর দানবিক আগ্রাসন চালিয়ে একে অন্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। যেটা অনেকটা ক্রীতদাস প্রথার মতো। মানুষও অদ্ভুত, সুবিধাবাদীর দল, নিজেদের স্বার্থে আগাছা, পরগাছা হতেও দ্বিধাবোধ করছে না। অন্যের দাসত্ব মেনে নেওয়া এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
কোথায় যেন একটা শূন্যতা, বন্দিত্ব, দাসত্ব আর মানসিক বিপর্যয়। যেখানে নিজের মনটার নিয়ন্ত্রণ মানুষের নিজেদের দেহের ভেতরে নেই। হয়তো মানুষ ধীরে ধীরে এক-একটা মানসিক জরাগ্রস্ত প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে কিন্তু সেটা বোঝার মতো বোধশক্তি আর তার মধ্যে কাজ করছে না।
আর এই রোগ সারাবে কে। সব রোগ তো ওষুধে ভালো হয় না, সব রোগের তো ওষুধ থাকে না। উপসর্গ হয়তো থাকে, তাও সেটা মানুষের অভিনয়ে দৃশ্যমান থাকে না, অদৃশ্য থাকে। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো, মানুষের ছায়াটাও আর মানুষের সঙ্গে নেই।
তার পরও মানুষ নিজের ভেতর থেকে ভাবুক। মুখোশটা খুলে পড়ে যাক মাটিতে, সেটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসুক মানুষের মুখ। মানুষ আবার ফিরে যাক জীবনবোধের কাছে।
লেখক:শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট,
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সূত্র : ইত্তেফাক


Facebook Comments Box


Comments

comments

advertisement

Posted ৯:২২ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত