শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০

চিকিৎসকের চোখে করোনাভাইরাস

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) | রবিবার, ২৯ মার্চ ২০২০ | প্রিন্ট  

চিকিৎসকের চোখে করোনাভাইরাস

চিকিৎসক হিসাবে করোনাভাইরাসের এই সময়টায় আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধটা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে আমাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশাটাও। বিশেষ করে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই মুহূর্তে যখন সারা বাংলাদেশে চলছে দশ দিনের সরকারি ছুটি, তখন সঙ্গত কারণেই উর্ধ্বমুখী এই প্রত্যাশার পারদ। আমার জায়গা থেকে আমি যখন পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করি তখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে দু’টি বিষয়। প্রথমটি আমার পেশা সংশ্লিষ্ট আর অন্যটি আমার রোগীদের সাথে সম্পর্কিত।

আমি জানি পারসোনাল প্রটেকশন ইক্ইুপমেন্ট সংক্ষেপে পিপিই নিয়ে আমার সহকর্মীদের মাঝে অনেক অসন্তোষ আছে। আমরা যারা স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত তাদের প্রত্যেকেরই পিপিই প্রয়োজন। পিপিই প্রয়োজন যেমন চিকিৎসকের তেমনি প্রয়োজন নার্স, টেকনিশিয়ানসহ প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর। পিপিই যেমন লাগবে আমার, তেমনি লাগবে আমার সেই সহকর্মীরও যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে সঙ্গ দেবেন তার শেষ সময়টায়, কিন্তু ভুলেও ভাববেন না এই সঙ্গ দেয়াটাই তার নিজের সর্বনাশের কারণ হতে পারে। তবে আমাদের পার্সোনাল প্রটেকশনের মাত্রাটা আমাদের ঝুকির মাত্রা বিবেচনায় অবশ্যই দু’রকমের। আমার যে সহকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি সেবা প্রদান করবেন, তার পূর্ণাঙ্গ পিপিই’র প্রয়োজন আমার চেয়ে অনেক বেশি। আর আমার জন্য হয়ত একটা প্রটেক্টিভ মাস্ক আর গ্লাভসই যথেষ্ট।


আমরা যদি সবাই একই রকমের পূর্ণ প্রটেকশন নিয়ে আমাদের পেশার দায়িত্বটা পালন করতে পারতাম তাহলে তো খুবই ভাল হতো। কিন্তু বাস্তবে তো তা সম্ভব না। কারণ বাস্তবটা এই যে, সারা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে পিপিই’র প্রচণ্ড সংকট। নিউইয়র্কে কয়েক হাজার পিপিই’র চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেয়া হয়েছে মাত্র চারশটি। খোদ মার্কিন মুলুকে চিকিৎসকরা একই পিপিই একাধিকবার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি প্রবল পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিপিই চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে।

বন্ধুপ্রতীম কোনো দেশের বিপদে পাশে দাঁড়ানোটা আমিও সমর্থন করি। ক’দিন আগে আমরা চীনকে পিপিই দিয়েছিলাম বলে আমি সরকারকে দোষ দেই না। বরং প্রশংসা করি। কারণ সেদিন দিয়েছিলেন বলেই আজ তাদের বিমান বোঝাই পিপিই এসে পৌঁছেছে আমার প্রয়োজনে আমার হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরে। নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে পিপিই দিয়ে ভারত সরকার আরো একবার প্রমাণ করেছে একাত্তরের চেতনা এখনও প্রবাহবান পদ্মায়-গঙ্গায়।


তবে এটাও সত্যি, আমার আর আমার সহকর্মীদের পিপিই’র চাহিদা পূরণ করতে হবে আমাদের নিয়োগকর্তাকেই। আমাকে যদি বলা হয় নিজের মাস্কটা নিজে যোগাড় করে নিতে, কিংবা বড়কর্তা যদি পিপিই পাওয়ার আমাদের ন্যায্য দাবিকে আমাদের ফাঁকি দেয়ার অজুহাত হিসেবে দেখতে চান, তখন আমি বিনয়ের সাথে বলতে বাধ্য হই যে, আমার চোখে তার অবস্থান অনেক নিচে।

আমরা চিকিৎসকরা অবিবেচক নই। আমরা বুঝি সীমাবদ্ধতাটা কোথায়। পৃথিবীর কোথাও কেউই তো এমন দুর্যোগের জন্য তৈরি ছিলেন না। কিন্তু তাই বলে আমাদেরকে দোষ দিলে হবে না। বললে হবে না, ‘যান, নিধিরাম সর্দার – ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই নেমে যান যুদ্ধে’। আমরা কেন কোনো মানুষই তা করবে না, কোনো দেশেই না। পুলিশ কখনো বন্দুক ছাড়া ডাকাতের পিছু নেয় না। এমনকি অ্যাপার্টমেন্টের ঐ যে সাধারণ দারোয়ান, সেও কি পাহারা দেয় লাঠি-সোটা ছাড়া? কাজেই কেউ যদি পেশার নেতার দাবিদার সেজে আমাদেরকে বিনা প্রস্তুতিতে সাহসী হতে বলেন, তাহলে ঐ নেতার প্রতি আমার সৎ পরামর্শ হবে অনুগ্রহ করে নেতৃত্ব থেকে অবসর নিন। আর অন্য পেশার সহকর্মীরা যখন মহামুল্য পিপিই-কে বেছে নেন সঙ সেজে ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাস দেয়ার উপলক্ষ্য হিসেবে, তখন তাদের জন্য আমার শুধু ঘৃণা ও ধিক্কার।


এই ছুটিতে যানবাহন চলাচল যেমন বন্ধ থাকছে, তেমনি বন্ধ থাকছে শুধুমাত্র ওষুধ আর খাবার-দাবার ছাড়া অন্যান্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের হোম-কোয়ারেন্টিনের শর্ত না মেনে যত্রতত্র মেলামেশা সরকারকে বাধ্য করেছে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে। আর সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার এই সরকারি সদিচ্ছাকে ঈদের ছুটি বানিয়ে হাজার-হাজার মানুষের ঢাকা ত্যাগ এখন গোটা দেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। তবে এখনো যদি খুব কড়াকড়িভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাটা ধরে রাখা যায় তাহলে আশা করা যেতেই পারে যে, আমাদের দেশের পরিস্থিতি ইতালি কিংবা স্পেনের মত হবে না।

আপনি যদি প্রবাস ফেরত হয়ে থাকেন কিংবা ঐ লাখো মানুষের একজন হন যারা গত ক’দিনে ‘দুলক-ভুলক-গোলক ভেদিয়া’ ঢাকা থেকে পৌঁছে গেছেন নিজ-নিজ গ্রামে, তাহলে এখন অন্তত সংযত হন। সীমিত আকারে করোনার যে সামাজিক বিস্তৃতি ঘটতে যাচ্ছে তা আইইডিসিআর-এর পরিচালকের বয়ানেই আমরা জেনে গেছি। এখন দেশটাকে ইতালি-ইরান না বানাতে চাইলে উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরই। এজন্য কঠিন পুলিশি ব্যবস্থা নিতে পারে রাষ্ট্র, নামাতে পারে সেনাবাহিনীও। রাষ্ট্র তার কাজটা ঠিকমতই করছে। তারপরও পুরোপুরি কাজ হবে না যদি না আমরা নিজেরা ঠিক হই।

চিকিৎসক হিসাবে আমরা বেশ বুঝি যে এই সময়টায় মানুষ এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে আছেন। এজন্য কিন্তু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। আইইডিসিআর-এর হান্টিং নাম্বারের সংখ্যা বৃদ্ধির সুখবরটা আমাদের সবার জন্য স্বস্তিদায়ক। ঢাকার বাইরেও প্রতিটি জেলায় চালু করা হচ্ছে হটলাইন নাম্বার। পাশাপাশি বিভিন্ন মিডিয়া হাউসগুলোর এবং পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলোও চালু করতে যাচ্ছে হটলাইন নাম্বার যেখানে ফোন করে যে কেউ তার মনের সংশয়টা দূর করতে পারবেন সঠিক পরামর্শ পেয়ে।

যেকোনো এপিডেমিক আর প্যান্ডেমিককে সফলভাবে মোকাবেলা করার একটা বড় শর্ত হচ্ছে আমাদের হাঁটতে হবে এর আগে আগে, এর পিছনে ছুটলে চলবে না। আর এর জন্য একটা অন্যতম করণীয় হচ্ছে প্রকৃত সন্দেহভাজন রোগীগুলোকে আরো বেশি-বেশি আর আরো তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করে শনাক্ত করা। আর তাদের সাথে যাদের সামাজিক মেলামেশা তাদেরও দ্রুত আনতে হবে কোয়ারেন্টিনের আওতায়। শুধুমাত্র এভাবেই সম্ভব একটা প্যান্ডেমিক-এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা। এরই মাঝে ঢাকার জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে পিসিআর-এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস নির্ণয়ের ব্যবস্থা কার হয়েছে। আর শীঘ্রই চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহ, কক্সবাজারসহ একাধিক সরকারি মেডিকেল কলেজেও এই পরীক্ষার সুযোগ বিস্তৃত হতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি একাধিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানও করোনা স্ক্রিনিং কিট আনার ব্যবস্থা করছেন। তবে মনে রাখতে হবে আমরা যদি শুধু অজানা আশঙ্কার জায়গা থেকে এসব নাম্বারে বারবার ফোন করি তাহলে আমাদের এই অযথা ফোনকলগুলো এই নতুন হান্টিং নাম্বারগুলোকেও খুব দ্রুতই এনগেজড করে ফেলবে। কাজেই এক্ষত্রেও আমাদের দায়িত্বশীল আচরণটা খুব বেশি প্রত্যাশিত।

কখন, কাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ভেবে পরীক্ষা করা হবে এই পলিসিটা প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব কিন্তু তা নির্ধারণ করা হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মকানুন অনুসরণ করেই। এই মুহুর্তে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের আন্তর্জাতিক ট্রান্সমিশনের পাশাপাশি স্থানীয় ট্রান্সমিশন চলছে। এখনও সামাজিক ট্রান্সমিশনটা দেখা দেয়নি। এই অবস্থায় যদি কারো বিদেশ থেকে সম্প্রতি দেশে আসার কিংবা সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন অথবা করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমনি কারো সংস্পর্শে আসার ইতিহাস না থাকে তাহলে তাদের জন্য করোনাভাইরাসের পরীক্ষা জরুরি নয়। তবে কারো যদি এটিপিক্যাল নিউমোনিয়া কিংবা অন্যকোনো জটিল রোগ যেমন, কিডনি ফেউলিউর, হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, লিভার সিরোসিস ইত্যাদি থাকে তবে তাদেরও পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। তবে সবার আগে তাদের থাকতে হবে করোনার লক্ষণ অর্থাৎ জ্বর, শুকনো কাশি, শ্বাসের সমস্যা আর বুকে চাপ লাগার কমপ্লেইন।

আমি আশাবাদী মানুষ। আমি তাই আর চৌদ্দটি দিন পরে আশার অনেকগুলো কারণ খুঁজে পাই। একাত্তরে এই জাতি জেগে উঠেছিল। আমার বিশ্বাস সেই একই চেতনায় আমরা আবারো জেগে উঠবো। সেদিন আমাদের একতা ছিল আমাদের বল। আর এবার আমাদের বিজয়ী করবে আমাদের মানসিক ঐক্য। একজন চিকিৎসক হিসাবে আমাকে প্রতিদিন শতাধিক লোকের সান্নিধ্যে আসতে হয়। এদেশের মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার আমার যে অভিজ্ঞতা, তা থেকে এই বিশ্বাস আমি রাখতেই পারি।

লেখক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব

Facebook Comments Box

Comments

comments

advertisement

Posted ৩:৫৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৯ মার্চ ২০২০

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত