মঙ্গলবার ১৯ মার্চ, ২০২৪ | ৫ চৈত্র, ১৪৩০

ক্ষতিকর খাবারের ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ | সোমবার, ০৮ নভেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট  

ক্ষতিকর খাবারের ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন

সারা বিশ্বে কোমল পানীয় আর জাংক ফুডের তাণ্ডব চলছে। আমেরিকানরা প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন গ্যালন সোডা বা গড়ে ৮০০ বোতল কোমল পানীয় পান করে। বাংলাদেশের মানুষও কোমল পানীয় (কোক, পেপসি, সেভেন আপ ইত্যাদি) পানে কম  যায় না। কী আছে এসব পানীয়তে? কত খারাপ ও ক্ষতিকর এসব পানীয়? আমরা বেশি কিছু জানি না। জানলে অবশ্যই এসব পানীয় মানুষ পান করত না। 
বলি শুনুন। ৩৫৫ মিলি কোমল পানীয়তে রয়েছে ১২ চামচ চিনি বা ক্ষতিকর উচ্চ মাত্রার ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপ। এই সিরাপ তৈরি হয় জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য থেকে যা স্বাস্থ্যসম্মত নয় বলে তুমুল বিতর্ক রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত চিনি হার্টের রক্তনালিতে প্রবাহ সৃষ্টি করে যা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। রয়েছে ফসফোরিক অ্যাসিড যা পানীয়র পিএইচকে ৩.২-তে নামিয়ে আনে এবং প্রচণ্ড অ্যাসিডিক এই পিএইচ শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। ফসফোরিক অ্যাসিড না থাকলে যে পরিমাণ চিনি পানীয়র মাধ্যমে আমরা গ্রহণ করি তা বমি হয়ে যেত। কোমল পানীয়তে শিশুর দাঁত রাখলে তা দুয়েক দিনে গলে যায়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কোমল পানীয় পান করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। ৬ লাখ মানুষের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, অতিরিক্ত চিনি, ফসফোরিক অ্যাসিড, সোডিয়াম বাইকার্বনেট, কেরামেল রং, ক্যাফেইন ও আরো অসংখ্য অজানা উপকরণসমৃদ্ধ কোমল পানীয় পান করে প্রতি বছর ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষ ডায়াবেটিস, ৪৫ হাজার হার্ট অ্যাটাক এবং সাড়ে ৬ হাজার ক্যানসারে মারা যায়। কোমল পানীয় পান করে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ওজন বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিশু ও বয়স্ক মানুষের মধ্যেও ওজন বাড়ার প্রবণতা মারাÍক হয়ে দেখা দিয়েছে। উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইন স্নায়ু উত্তেজক যা ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করে।
ক্যাফেইন রক্তচাপ ও আসক্তি বাড়ায়। শিশুদের কোমল পানীয় পান থেকে বিরত রাখুন। কোমল পানীয় শিশুদের দাঁত নষ্ট ও শরীরের ক্ষতি করে। কোমল পানীয় অনেক ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস বা ধ্বংস করে। টিনজাত কোমল পানীয় ভয়ঙ্কর। কারণ, টিনের ভেতরের দেওয়ালে থাকে বিসফেনল যা ক্যানসার সৃষ্টি করে। অ্যাসপারটেম-সমৃদ্ধ জিরো ক্যালরির কোমল পানীয় আরো খারাপ। অ্যাসপারটেম-সমৃদ্ধ কোমল পানীয় ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। অনেকেই কমোড ও বেসিনের দাগ তোলার জন্য ডিটারজেন্ট হিসেবে কোক-পেপসি ব্যবহার করে। তাই আপনারা সবাই কোমল পানীয় বর্জন করুন, প্রচুর পানি পান করুন। আপনারা সুস্থ থাকুন।
চিনি আমাদের কী ক্ষতি করে? অনেক। নিকট অতীতে আমেরিকায় চিনি সংক্রান্ত এক অবিশ্বাস্য কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হয়েছে। সুগার অ্যাসোসিয়েশন রিসার্চ প্রোজেক্ট ২২.৬ এর আওতায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা দুজন গবেষককে ৫০ হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছিল চিনি বাদ দিয়ে হার্ট অ্যাটাকের জন্য চর্বি ও কোলেস্টেরলকে দায়ী করে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার জন্য। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হার্ভার্ডের গবেষণা প্রবন্ধে হার্ট অ্যাটাকের জন্য একতরফাভাবে চর্বি ও কোলেস্টেরলকে দায়ী করা হয়। অথচ পরিমিত চর্বি ও কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ নয়। কোলেস্টেরল ছাড়া এক দণ্ডও আমাদের শরীর চলে না। অথচ এই মহা উপকারী কোলেস্টেরলকে মহা কালপ্রিট বানিয়ে ছাড়ল ঘুষখোর দুই গবেষক। সেই গবেষণায় চিনির সব ক্ষতিকর দিকগুলোকে বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। পরবর্তী অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, চিনি হলো এক মহাকালপ্রিট যার কারণে শরীরে বহু রোগের উৎপত্তি হচ্ছে। কার্ডিয়াক প্রবলেম, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, কিডনি ফেলিয়ারসহ অসংখ্য রোগের উৎপত্তির কারণ চিনি। চিনি হার্টের রক্তনালির অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে প্রদাহ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ক্ষতে আঁশ, প্লেটিলেট, লাইপোফেইজ, চর্বি ও ক্ষতিকর কোলেস্টেরল ও ট্রান্স ফ্যাট জমে গিয়ে ইশকিমিয়া ও মাইওকার্ডিয়াল ইনফার্কশন সৃষ্টি করে। এর ফলে মানুষ অসুস্থ হয় অথবা কার্ডিয়াক ফেলিয়ারের কারণে মারা যায়। লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, ডায়াবেটিসের রোগীরা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে বেশি মারা যায়। কালপ্রিট চিনি অব্যাহতি পাওয়ার পর সুগার অ্যাসোসিয়েশন মওকা পেয়ে গেল এবং এই সুযোগ সদ্ব্যবহার করে সারা বিশ্বব্যাপী বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের চিনি, চিনিসমৃদ্ধ কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক, আইসক্রিম, মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের ব্যবসা চালিয়ে যাবার অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে গেল। বর্তমানে বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ স্থূল এবং এই স্থূলতার মূল কারণ চিনি। চিনি ও পরিশোধিত চিনির খাবার খেয়ে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে। ৫০ বছর আগে প্রফেসর ইয়াদগিন প্রাণী ও মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে বলেছিলেন, চর্বি ও কোলেস্টেরল নয়, চিনিই হার্ট অ্যাটাকের আসল কারণ। ২০১৪ সালে কার্ডিওলোজিস্ট এটকিন বলেছিলেন, হাই ফ্যাট ও লো কার্বোহাইড্রেট ডায়েট মানুষের ওজন কমায়, লো ফ্যাট ডায়েট নয়। এই একই কথাগুলো আমি বলে আসছি বহু বছর ধরে। মানুষ শুনছে আর বিশ্বাসও করছে। কিন্তু পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকরা বিশ্বাস করে না। তারা রোগী ও সুস্থ মানুষকেও ডিম, দুধ, বাটার, পনির এবং অন্যান্য কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার খেতে নিষেধ করে, অথচ কোল্ড ড্রিংক, এনার্জি ড্রিংক, আইসক্রিম, টফি, ক্যান্ডি, চকলেট, অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট, চিনি বা চিনিসমৃদ্ধ খাবার খেতে নিষেধ করে না। অবাক কাণ্ড !
কেন কোমল পানীয়র পরিবর্তে পানি খাবেন তা জানা জরুরি। আমাদের শরীরের ৭২ শতাংশ  পানি। হাড়ের এক-চতুর্থাংশ, পেশির তিন-চতুর্থাংশ, মস্তিষ্কের ৮৫ শতাংশ, রক্ত ও ফুসফুসের ৮০ শতাংশ হলো পানি। পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীর থেকে অতি সহজে বর্জ্য পরিষ্কার হয়ে যায় এবং কোষে পর্যাপ্ত পুষ্টি ঢুকতে পারে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করলে ৮০ শতাংশ ভুক্তভোগীর পিঠ ও গিঁটের ব্যথা সেরে যায়। শরীরের ২ শতাংশ পানিস্বল্পতা দেখা দিলে সাময়িকভাবে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। প্রতিদিন পাঁচ গ্লাস পানি পান করলে মলাশয়ের ক্যানসার ঝুঁকি ৪৫ শতাংশ, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ৭৯ শতাংশ এবং ব্লাডার ক্যানসারের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমে যায়। স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য। অতি ভোজন বর্জনীয়। খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। রাস্তার খাবার খাবেন না। খাবার হতে হবে কম ক্যালরিযুক্ত এবং বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। আমাদের খাবারের অর্ধেক হতে হবে শাকসবজি ও ফুলমূল। বাকি খাদ্যের মধ্যে থাকতে হবে ভুসিসমৃদ্ধ শস্য, বাদাম, বিভিন্ন ধরনের বিচি। তেল হিসেবে তিসির তেল, অলিভ অয়েল ভালো। সালাদ হতে হবে খাবারের অপরিহার্য অংশ। পরিশোধিত শর্করা, চিনি, সাদা রুটি, ময়দা, পেস্তা, কেক, কুকিজ, পিৎজা ও পেস্ট্রি খাবেন না, সম্পূর্ণ পেস্তা, চাল ও আটা খাবেন। খাসি ও গরুর গোশত যত কম তত ভালো। প্রোটিন হিসেবে মাছ ও মুরগির (ফার্মের নয়) গোশত উৎকৃষ্ট। ট্রান্সফ্যাট বা পোড়া তেল, ফ্রি রেডিক্যাল ও চিনি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণ। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের জন্য বিশেষ উপকারি। কাঁচা লবণ খাওয়া ছেড়ে দিন। ডিম, দুধ ও দই স্বাস্থ্যকর খাবার। ভিটামিন-সি, বিটা ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ, ভিটামিন-ই, সেলেনিয়াম ও পলিফেনোল শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। সব অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, আঁশ ও খনিজের উৎকৃষ্ট উৎস ফলমূল, শাকসবজি ও সবুজ চা।
উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও ক্যানসার-জাতীয় প্রাণঘাতী রোগ থেকে বাঁচতে হলে বিয়েশাদি এবং অন্যান্য সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে ঘি, বাটার, ডালডা, চর্বি বা প্রচুর তেলসমৃদ্ধ পোলাও, রোস্ট, বিরিয়ানি, খাসি ও গরুর গোশত খাওয়া কমাতে হবে। জাংক ফুড খাবেন না। এসব খাবারে পুষ্টি কম, চর্বি বেশি। এ ছাড়া এসব খাবারে রয়েছে প্রচুর লবণ, চিনি, মনোসোডিয়াম গ্ল“টামেট ও টাট্রাজিন-জাতীয় বিতর্কিত খাদ্যোপকরণ। ম্যাকডোনাল্ড, বার্গার কিং, কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন, পিৎজা, হ্যামবার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই জাংক ফুডের কিছু উদাহরণ। জাংক ফুডে প্রচুর চিনি ও চর্বি থাকে বলে এমন খাবার খেলে ওজন বেড়ে যাওয়াসহ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, ক্যানসারের মতো বহু জটিল রোগের উৎপত্তি হয়। কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংক ছেড়ে দিন। চা, কফি, মিষ্টি পরিমিত। মদ ও মাদক হারাম করুন। ধূমপান ছাড়ুন। সুস্থ জীবনের জন্য ব্যায়ামের বিকল্প নেই। প্রতিদিন দুই মাইল বা তিন কিলোমিটার হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এতে সারা দিনের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি, অবসাদ ও দুশ্চিন্তা দূর হবে। ব্যায়াম করলে রাতের ঘুম ভালো হয়। সূর্যালোক শরীরে ভিটামিন-ডি তৈরি করে। ভিটামিন-ডি’র ঘাটতি হলে শরীরের ক্যালসিয়াম বিশোষণে বিঘ্ন ঘটে। ক্যালসিয়াম শরীরের জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সূর্যস্নান করা দরকার।
লেখক: অধ্যাপক ও ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

উৎস : ইত্তেফাক


Facebook Comments Box


Comments

comments

advertisement

Posted ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৮ নভেম্বর ২০২১

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত