২০১৩ সালের একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান খুন হন আপন মেয়ে ও-লেভেলপড়ুয়া ঐশী রহমানের হাতে। যার প্রেক্ষাপট ছিল মেয়ে ঐশীর মাদকে আসক্তি।
কয়েকদিন আগে বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খান মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়ে ইন্ডিয়ান পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। বলিউডের আরও অনেকে মাদককাণ্ডে নিমজ্জিত। এভাবে মাদকে আসক্তি অনেক ব্যক্তি এবং পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মাদকাসক্ত সদস্যকে নিয়ে অনেক পরিবার অশান্তির আগুনে জ্বলছে। দেশ পরিণত হচ্ছে মেধাহীন জনগোষ্ঠীতে। মাদকের সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশ বা ভারতে তা কিন্তু নয়, কম-বেশি সব দেশেই মাদকের সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে মাদকের সমস্যাটা বেশ পুরোনোও বটে। তবে কোনো কোনো দেশ কার্যকরী পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে মাদকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হচ্ছে, আবার কোনো কোনো দেশ তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু দেশে মাদকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, যা ধ্বংস করছে যুব ও তরুণ সমাজকে। এখন সময় এসেছে মাদকের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার।
একটা দেশের সবচেয়ে বড় এবং মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে যুব ও তরুণ সমাজ। আটার খমির থেকে যেমন অনেক মুখরোচক খাবার তৈরি করা যায়, তেমনি যুবক বা তরুণকে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেকোনো পেশায় যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। যারা পরবর্তী সময়ে সামাজিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। মাদক, এই সম্ভাবনাময় যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ আজ মাদকের ছোবলে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন খুব জরুরি আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে মাদকের ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করা। অন্যথায় আগামীর দিনগুলো হবে অনেক ভয়ংকর। তাই মাদক থেকে দূরে থাকুন, মাদককে না বলুন, মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
মাদক কী? মাদক হচ্ছে আসক্তির উপাদানসমৃদ্ধ এক ধরনের পণ্য যেমন ইয়াবা, হাসিস, আইস, হেরোইন, এলএসডি ইত্যাদি। অর্থনীতির ভাষায় মাদক ডিমেরিট বা ক্ষতিকর পণ্য। ক্ষতিকর পণ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভোক্তা এর ভোগ থেকে পাওয়া সন্তুষ্টি বা প্রশান্তি ‘অতি তাড়াতাড়ি বা এখনি’ অনুভব করে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল খুবই ভয়াবহ। এই ‘এখন-এর প্রলোভন’ দ্বারা তাড়িত হয়ে ভোক্তা সহজেই ক্ষতিকর পণ্যে আকৃষ্ট হয়। দীর্ঘদিন ক্ষতিকর পণ্য গ্রহণের ফলে ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। ক্ষতিকর পণ্য গ্রহণ অভ্যাসে বা আসক্তিতে পরিণত হয় এবং এ থেকে বেরিয়ে আসা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। উপকারী বা মেরিট পণ্যের মতো ডিমেরিট বা ক্ষতিকর পণ্যেরও বাজার আছে- চাহিদা, জোগান, মূল্য, উৎপাদন, বিনিয়োগ, লাভ- সবই আছে, তবে গোপনে। তাই ডিমেরিট বা ক্ষতিকর পণ্যের বাজারকে বলা হয় লুকানো বাজার বা হিডেন মার্কেট। সরকার মেরিট পণ্যের বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে যেমন উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে, তেমনি ডিমেরিট পণ্যের বাজার সংকোচনে সদা প্রচেষ্টা চালায়- আইন করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপের মাধ্যমে।\হমানুষ কেন মাদক গ্রহণ করতে যায়? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া যেমন কঠিন, তেমনি অযৌক্তিকও বটে। ভোক্তার মাদক ভোগের পেছনে অনেক গুণক যৌথভাবে কাজ করে থাকতে পারে- যেমন মতিভ্রম, হতাশা, অন্যের প্ররোচনা; আবার অনেক সময় বন্ধুদের চাপ, শখহীনতা, উপযুক্ত সামাজিক কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতি, পারিবারিক অশান্তি এবং কৌতূহল। পত্রপত্রিকার তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের পরিমাণ ৮০ লাখের মতো; যার প্রায় ৭০ ভাগেরও বেশি তরুণ। এই তরুণ প্রজন্ম কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বা অন্যের প্ররোচনায় বা উপযুক্ত কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতিতে মাদকে আসক্ত হয়ে থাকে। তরুণ প্রজন্ম হচ্ছে একটা দেশ, জাতি এবং অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাই তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার্থে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই। তবে এই যুদ্ধটা হতে হবে অন্যরকম যুদ্ধ।
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ধরনটা কেমন হতে পারে? এ সম্পর্কে কিছু বলার আগে একটা গল্প বলি। আমার বর্তমান আবাসস্থল ফিনল্যান্ডে ২০১০-১৩ সালের দিকে মাদক সমস্যা একটু জটিল আকার ধারণ করে। মাদকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণের একটু বাইরে চলে যাচ্ছিল। সরকারের টনক নড়ে। একই সঙ্গে নজরদারি বাড়ে। উৎকোচ গ্রহণের দায়ে ২০১৩ সালের নভেম্বরে হঠাৎ করে গ্রেপ্তার হন হেলসিঙ্কি পুলিশ বিভাগের মাদকবিরোধী শাখার প্রধান ইয়ারি আরনিয়ো। তদন্ত করতে গিয়ে বের হয়ে আসে তিনি ৮০০ কেজি হাসিস নেদারল্যান্ডস থেকে ফিনল্যান্ডে চোরাচালানে সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, দায়িত্ব গ্রহণ থেকে শুরু করে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তিনি হাসিস চোরাচালানে সহযোগিতা করে দেড় মিলিয়ন ইউরো অর্জন করেছেন। গ্রেপ্তারের দিন থেকে আজ পর্যন্ত এক দিনের জন্যও ইয়ারি আরনিয়ো কারাবাস থেকে মুক্তি পাননি। ২০১৬ সালে তাকে দেওয়া হয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ড। ইয়ারি আরনিয়োর বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আসছে। ফিনল্যান্ডে মাদক সমস্যা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে। মাদকের যুদ্ধে মাদকের সঙ্গে জড়িত কিছু রাঘববোয়ালকে প্রথমে ধরুন, শাস্তি প্রদান করুন, মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত সকল অর্থ বাজেয়াপ্ত করুন। এতে চুনোপুঁটিরা এমনিতেই হারিয়ে যাবে।
আর কি করা যেতে পারে? যেহেতু মাদকের বাজার সংকোচনে বা দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেহেতু একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইয়ারি আরনিয়োর মতো অনেক পথভ্রষ্ট সদস্য মাদক কারবারিদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ পণ্ড হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিটি ইয়ারি আরনিয়োকে দ্রুতই গ্রেপ্তার করে কঠোর সাজা দিতে হবে। শর্ষের মধ্যের ভূত আগে তাড়াতে হবে, নইলে মাদকের বিরুদ্ধে যে কোনো যুদ্ধে আমাদের পরাজয় অবধারিত। মনে রাখতে হবে বাঙালি পরাজিত জাতি না। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশ জিতবেই, জিতবে- এখন সময় শুধু এগিয়ে যাবার।
একজন অভিভাবক হিসেবে আপনি কি করতে পারেন আপনার সন্তানকে মাদক থেকে দূরে রাখতে? বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খান মাদকসহ গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে অকপটে বাবা শাহরুখ খানের সঙ্গে তার সম্পর্কের দূরত্বের কথা বলেছেন। আরও বলেছেন বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য তাকে ধর্ণা দিতে হতো শাহরুখ খানের ম্যানেজারের কাছে। মনে রাখবেন, আপনি যতই ক্ষমতাধর মানুষ হোন না কেন, সন্তানদের কাছে ব্যস্ত অভিভাবকত্বের মূল্য অনেকটাই শূন্যের কোঠায়। যতটা পারেন সন্তানদের সঙ্গে আপনার সময়, মূল্যবোধ, ধ্যানজ্ঞান ভাগাভাগি করুন- ওরা আপনার প্রতিচ্ছবি হয়ে এ ধরণীতে বিচরণ করবে।
কীভাবে বুঝবেন যে আপনার সন্তান মাদক নিচ্ছে? আপনার সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন কিছু সময় দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ-আলোচনা করুন, তার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন, স্কুল কেমন যাচ্ছে তার খোঁজ নিন, বন্ধু-বান্ধবদের সম্বন্ধে জানুন, প্রয়োজনে তার বন্ধু-বান্ধবের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করুন। এভাবে যদি দেখেন যে আপনার সন্তান আপনাকে তথ্য দিতে দ্বিধাবোধ করছে তাহলে বুঝবেন ওর কোথাও কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। তবে এতেও বিচলিত হবার দরকার নেই যে সে মাদক নিচ্ছে। তবে যদি তার আচরণগত কোনো পরিবর্তন আসে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা চায়, বাড়িতে ফিরতে দেরি করে, কার সঙ্গে মেলামেশা করছে তাদের সম্পর্কে তথ্য যদি দিতে না চায় তাহলে বুঝবেন আপনার সন্তান হয়তো মাদকে আসক্তের পথে এগোচ্ছে। তার প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, তাকে ভালোবাসুন, মাদকের খারাপ দিক সম্পর্কে বলুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।\হতরুণ সমাজের মধ্যে ‘এডুকেটিভ চেঞ্জ’ আনতে হবে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগতকরণের মাধ্যমে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণদের খেলাধুলা এবং বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে। গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত খেলাধুলা করে তারা জীবন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশি সচেতন হয়। আর জীবন ও স্বাস্থ্য সচেতনতা তরুণদের মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। সরকারকে বেশি বেশি খেলার মাঠ এবং ব্যায়ামাগার স্থাপন করতে হবে। আমাদের প্রচেষ্টা হতে হবে তরুণদের গঠনমূলক ও সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখা। আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো যে মাদকের সমস্যা শুধু আইন করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব না, ততই ভালো।
-শিক্ষক ও গবেষক
সমকাল
Comments
comments
Posted ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১
সংবাদমেইল | Nazmul Islam