
চিররঞ্জন সরকার | শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
মানুষ অনেক কিছুতেই ভয় পায়। তার মধ্যে কিছু বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে তাড়ানো সম্ভব হয়। কিছু ভয় মনের মধ্যে থেকেই যায়। কোনও বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগে না। তেমনই একটি হলো অন্ধকারের ভয়। নিজের ঘরে বসেও অনেকে এই ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। অন্ধকারে আতঙ্কিত হয়ে পড়ার এই সমস্যার একটি বৈজ্ঞানিক নাম রয়েছে। নিক্টোফোবিয়া। অনেকে বলে থাকেন অন্ধকারে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। কারণ আলো না থাকলে কিছু দেখা যায় না। কিন্তু কারও কারও এই ভয় থাকে অতিরিক্ত মাত্রায়। অন্ধকার হওয়া মাত্রই অস্থির হয়ে ওঠে মন। এক মুহূর্তও একা থাকতে পারেন না অন্ধকারে। তাদের এই অস্বস্তিকে নিক্টোফোবিয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন চিকিৎসকেরা। রোজকার জীবনে অনেক অসুবিধায় পড়তে হয় এর কারণে।
কিন্তু অন্ধকারে কেন ভয় হয়? এ নিয়ে নানা জায়গায় গবেষণা হয়েছে। একটি কথা প্রায় সব জায়গার গবেষকরাই মানেন। তা হলো, এই নিক্টোফোবিয়ার পেছনে রয়েছে মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস। প্রাচীন যুগে যখন শহর বা গ্রামে থাকার ব্যবস্থা হয়নি, এর উৎস সে সময়ে। জঙ্গল বা গুহায় বসবাসকারীরা রাতে জন্তুর ভয় পেত। কখন বাঘ-ভাল্লুক এসে আক্রমণ করবে রাতের অন্ধকারে, তা নিয়ে আতঙ্ক থাকত। সেই উদ্বেগ জিনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কারও বেশি সমস্যা হয়, কারওবা কম। কিন্তু মোটের ওপর বেশিরভাগ মানুষই অস্বস্তি বোধ করে অন্ধকারের মধ্যে।
শুধু অন্ধকার নয়, মানুষ অজানাকেও ভয় পায়। যা কিছু অদেখা, অচেনা, তা কেমন হবে, তা নিয়ে মনের মধ্যে ভয় কাজ করে। কারণ ওদের মনে কী আছে আমরা জানি না। অপরিচয় থেকে ভয়, ভয় থেকে গভীর অবিশ্বাস, সেই অবিশ্বাস গড়ছে মানসিক হিংসা। সেই লালিত হিংসাই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে ফেলছে অপরাধে। এই অচেনা, অজানা থেকে যে ভয়, সে ভয় যুক্তিহীন, বিচারহীন, বিশ্লেষণহীন। যে ভয়ের নাম ‘ফোবিয়া’। এ জিনিস যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে। আমি যখন স্থির করেই নিয়েছি যে ভয় পাব, তখন তো আর যুক্তি এসে তাকে খণ্ডাতে পারে না। তখন কেবল ভয় পাব বলেই ভয় পাওয়া। এই ভয়টা নিজেকে নিজেই ধারণ ও লালন করে চলে। মন ও মস্তিষ্কের চারপাশে অভেদ্য দেওয়াল তুলে দেয়। যে দেওয়াল ভেদ করে যুক্তি কেন, কোনও বোধই ঢুকতে পারে না। এই ভাবেই অপরিচয় আরও বেড়েই চলে। সেই অজানাকে যত দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়, তার থেকে সঞ্জাত ভয় ততই পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়।
মানুষ মৃত্যুকেও ভয় পায়। ভয় পায় ভূতে, ভগবানে। এসব ভয় মানুষকে সারাজীবন তাড়িয়ে ফেরে। তবে এসব ভয়কে ‘তুচ্ছ’ করে বর্তমানে দেশে গড়ে উঠেছে অন্য এক ভয়ের সংস্কৃতি। অজানা-অচেনা বিপদের ভয়। আক্রান্ত হওয়ার ভয়। হামলা-মামলার ভয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত-অপমানিত হওয়ার ভয়। প্রতিবাদ-সমালোচনা যে একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু তার পরও আছে ভয়। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ‘বিরুদ্ধমত দমন’ ও ‘শক্তিপ্রয়োগের নীতির’ কারণে এই ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই ভয় একপাক্ষিক নয়, যারা ভয় পাচ্ছেন আর যারা ভয় দেখাচ্ছেন, তাদের উভয়ের মধ্যেই রয়েছে একটা সংশয় আর উদ্বেগ। মনে জাগছে নানা দার্শনিক প্রশ্ন– আমাদের বেঁচে থাকা কি কেবলই ভয় আর আশঙ্কার সমষ্টি? আরও ব্যাপকভাবে ভাবলে, সভ্যতা সৃষ্টির মূলে কি ভয়? আর সেই ভয় থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই কি ভয় সৃষ্টি করা হচ্ছে?
হয়তো তাই। মানুষ একসময় ভয় পেত প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপকে। সেই ভয়ঙ্কর রূপ থেকে বাঁচার তাগিদে আশ্রয় নিয়েছিল গুহায়। মানুষ ভয় পেত অন্ধকারকে। সেই অন্ধকারের হাত থেকে বাঁচার তাগিদে আবিষ্কার করল আগুন। মানুষ ভয় পেত অন্য গোষ্ঠীর মানুষকে। তাই বাঁচার তাগিদে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে শিখল। মানুষ সব থেকে বেশি ভয় পেত মৃত্যুকে। মৃত্যু তার কাছে ছিল রহস্যময়। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইত না, মৃত্যুতেই জীবনের শেষ।
তার সব কিছুতেই ভয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাবার ভয়, ভূমিকম্পের ভয়, বন্যার ভয়, ঝড়-বৃষ্টির ভয়, অসুখের ভয়, জীবনহানির ভয়। ভয়ের দ্বারাই মানুষ চিরকাল তাড়িত।
আমরা চাই আশ্রয়। আমরা চাই এমন একজনকে, যে আমাদের রক্ষা করবে, যে আমাদের সমস্ত ভয় থেকে মুক্তি দেবে। তাই আমাদের মধ্যে ভয় যেমন আছে, তেমনি ভয়কে অতিক্রম করার চেষ্টাও আছে। আর তা আছে বলেই মানবসভ্যতা আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। নইলে আমরা ভীতু হয়ে আদি যুগে পড়ে থাকতাম। আজ যে সারা পৃথিবীজুড়ে এত ঘরবাড়ি, এত রাস্তাঘাট, এত যানবাহন, এত যন্ত্রপাতি, এত অস্ত্রশস্ত্র– এসব কিসের জন্য?
সবই হয়েছে ভয় থেকে বাঁচার তাগিদে। মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ। মানুষ আজ সব থেকে ভয় পায় মানুষকে। শুনেছি সাপ খুব ভীতু। সাপ ভয় পেয়েই মানুষকে কামড়ায়। আমরা অনেকটা সাপের মতো। অমুক দেশ আমাকে আক্রমণ করতে পারে। অতএব অমুক দেশকে শায়েস্তা করো। কীভাবে করব? আমাদের গায়ে শক্তি নেই। আমরা দুর্বল। সেই কারণেই তৈরি হলো অস্ত্র। এখন আর আদিযুগের অস্ত্র নেই। ছুরি, তরবারির যুগ পেরিয়ে নিউক্লয়ার বোমার যুগে এসেছি। এখন তৈরি হয়েছে আবার নানা ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র। যা নাকি মুহূর্তের মধ্যে নিঃশব্দে বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। এর উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য একটাই। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করো। কারণ শত্রুকে নিশ্চিহ্ন না করতে পারলে আমি নির্ভয়ে শান্তিতে থাকতে পারব না।
ভয় থেকে জন্মায় ক্রোধ। আর ক্রোধ থেকে জন্মায় যুদ্ধের স্পৃহা। অথচ আমরা ভেবে দেখি না, যুদ্ধ আমাদের দুই পক্ষকেই ধ্বংস করে। কারণ যুদ্ধে যে জয়ী হয়, সে যুদ্ধের পরে এমনই বিপর্যস্ত হয় যে, তা এক রকম পরাজয়। এই যে দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধ হলো, তাতে লাভ হলো কার? কে হলো সমৃদ্ধ? কেউ হয়নি। তবে এই যুদ্ধের দৌলতে যানবাহনের উন্নতি হয়েছে, অস্ত্রশস্ত্রের উন্নতি হয়েছে। মানুষের ধ্বংস করার কাজ অনেক সহজ হয়েছে। এখন ঘরে বসেই অন্য দেশের বুকে বোমা ফেলে আসতে পারি। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। এর মূলে কি বিজ্ঞানের উন্নতি? নাকি ভয়? অবশ্যই ভয়। ভয় থেকেই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মরতে চাই না। তাই ঘরে বসে আমরা শত্রুদের ধ্বংস করতে চাই। আগে যুদ্ধ ছিল, বীরত্বও ছিল। এখন যুদ্ধ আছে, বীরত্ব নেই।
বর্তমানে আমরা বিজ্ঞানকে ভয় পাই। ভক্তি করি। বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে পারি না। আজ যে আমরা সুখে জীবনযাপন করছি, সে তো বিজ্ঞানের কল্যাণেই। তবে কখন যে বিজ্ঞানের মারমুখী চেহারা দেখব, তা বলতে পারছি না।
বিজ্ঞান ছাড়া আর একটি বস্তুকে আমরা ইদানীং খুব ভয় পাচ্ছি। সে বস্তুটি হলো রাজনীতি। আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ। সব মানুষই চায় ক্ষমতা। কেন চায় ক্ষমতা? ক্ষমতা চায় সেই ভয় থেকে। কারণ, হাতে ক্ষমতা থাকলে আমার ভয় কমবে। আমার পাশে থাকবে দল, থাকবে প্রশাসন। থাকবে পুলিশ। আমি শান্তিতে বাঁচতে পারব। কিন্তু শান্তিতে বাঁচা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে সহজ নয়। কারণ দল ও পক্ষ তো একটি নয়। একাধিক। সব দলই ক্ষমতায় বসতে চায়। ফলে এক দল আর এক দলকে উৎখাত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তার জন্যে মারামারি কাটাকাটি। সুতরাং, নেতারাও অশান্তিতে ভয়ে ভয়ে দিন কাটান। ক্ষমতায় বসে সবসময় উৎখাতের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। আর আমাদের অবস্থা হয় করুণ। কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আমরা হচ্ছি উলুখাগড়া। দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যখন মারামারি হয়, আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি। কারণ মারামারি তো হাত দিয়ে হয় না, হয় বোমায়, পিস্তলে, অগ্নিসংযোগে। আমরা ভয়ের চোটে গ্রাম ছেড়ে পালাই। কিন্তু কোথায় পালাব? কে আমাদের আশ্রয় দেবে? ঈশ্বর? বিজ্ঞান? না, এরা কেউই আশ্রয় দিতে পারবে না। আমাদের আশ্রয় দেবেন নেতারা। মহামানবদের মতো তাদেরও একটাই কথা। তারা বলবেন, তোমরা আমাকে ভজনা করো। যদি নিষ্ঠাভরে ভজনা করো, তাহলে তোমাদের অর্থ হবে, বাড়ি হবে, গাড়ি হবে। আর যদি না করো, তাহলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
আমরা দুর্বল অসহায় মানুষ। আমরা তাই যুগ যুগ ধরে ভয়ে ভয়ে থাকি। ভয় থেকে আমাদের মুক্তি হয় না। আরও ভয় বাড়ে।
উৎস : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Posted ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.