
স্টাফ রিপোর্টার,সংবাদমেইল২৪.কম | বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ | প্রিন্ট
ষাটের দশকের শুরুর দিক। আড়িয়াল খাঁ নদী বিধৌত মাদারীপুর এখনকার মতো এত ব্যস্ত ছিল না। জনবসতি ছিল অনেক কম। গাছ-গাছালির আধিক্যে অনেকটা জঙ্গলে ভরা ছিল মনোরম এ শহর। মাদারীপুর জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরবর্তী চরমুগুরিয়া বন্দর। চরমুগুরিয়া বন্দর এলাকা বানরের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত ছিল একসময়। আশেপাশের এলাকা থেকে এখানে জনবসতি কম ও বন-জঙ্গল থাকায় শুধু বানর নয় হনুমানেরও বিচরণ ছিল এখানে। কালক্রমে ফলদ উদ্ভিদ কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিক খাবার সংকট তৈরি হয় বানরদের। তাছাড়া আগে মাদারীপুর পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকে বানরদের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখন সেটিও বন্ধ রয়েছে।
এই শতাব্দীতে এসে বানরেরা যেন আর ধরে রাখতে পারছে না তাদের রাজ্যের সুনাম। এক সময় নিজের আবাস স্থলেই এখন একরকম আশ্রিত এই বন্য প্রাণীরা।
মাদারীপুর জেলা শহর থেকে সকাল ৯টায় রওনা দিলাম বানর রাজ্য অভিমুখে। কিছুটা দেখে আসার ইচ্ছে ওদের হাল-হকিকত। শহর থেকে মোটর বাইকে করে খাগদী বাসস্ট্যান্ডে এসে যাত্রা বিরতী। সেখান থেকে পায়ে হেটে বানররাজ্য চরমুগুরিয়ার অভিমুখে যাত্রা। গাছের ডালে আনমনে বসে থাকা বানর দেখার ইচ্ছে মনে মনে।
পাকা রাস্তার দুধারে কাঁচা-পাকা বসতবাড়ি। এক সময়ের বনে ঘেরা এই গ্রামটি দেখলে এখন আর তা বোঝার উপায় নেই। চরমুগুরিয়া বাজারের কাছাকাছি আসতেই পথে একটি দুটি করে বানর চোখে পরতে শুরু করে। আশায় ছিলাম গাছের ডালে ডালে বসে থাকতে দেখবো বানরের দল।
কিন্তু প্রকৃতির বিরূপতা ও মানব বসতি বৃদ্ধির ফলে কমে গেছে বানরের সংখ্যা। দিন দিন বানরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলেও জানান স্থানীয়রা।
চরমুগুরিয়া বাজারের পাশেই একটা খোলা মাঠ। এ মাঠেই সাধারণত দেখা পাওয়া যায় বানরদের। তবে সারাক্ষণ এরা মাঠেই বসে থাকে না। কোন খাবার নিয়ে কেউ মাঠে এসে দাঁড়ালেই চারপাশ থেকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বানরগুলো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে।
সাধারণত বানর দেখতে আসা লোকজন খাবার (বিস্কুট জাতীয় কিছু বা কলা) নিয়ে মাঠে এসে দাঁড়ায়। আমিও বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছি মাঠের মধ্যে। একটু পরেই একটি দুটি করে আসতে শুরু করে বানর। শিশু, মাঝারি, বয়স্ক ১০ থেকে ১৫টি বানর এসে দাঁড়ায় আমাদের ঘিরে। চোখে-মুখে ক্ষুধার স্পষ্ট ছাপ। দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত পর্যাপ্ত খাবার থেকে বঞ্চিত এই রাজ্যের বাসিন্দারা।
শরীর দেখলেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন ধরে খাবারের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমাদের খাবারের প্যাকেটের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বানরগুলো। যেন অপেক্ষা আর সইছে না। মুখ দিয়ে ভেঙচিও কাটছে ঘন ঘন। কিছুটা ভয়ে ভয়েই বিস্কুটগুলো ছড়িয়ে দিতেই হুমরি খেয়ে পড়লো ছড়িয়ে থাকা বিস্কুটের উপর। তাদের মধ্যে মারামারি বেঁধে যায় খাবার নিয়ে।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমানে ক্ষুধার তাড়নায় এসব বানর মানুষের বাসা-বাড়িতে চলে আসে। রান্না ঘর থেকে খাবার চুরি করে খায়। বাচ্চাদের হাতে খাবার দেখলেই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। খাদ্যের অভাবে অনেক বানরই এলাকা ছেড়ে মাদারীপুর শহরে চলে এসেছে। এই বন্দরে প্রায় দেড় হাজারের মতো বানর আছে। এরা কালীবাড়ি, জেসম একাডেমি, জেটিসি ফাঁড়ি ও জমাদ্দার মিল এলাকায় বিভক্ত হয়ে বাস করছে। বানরগুলো আলাদাভাবে দলবদ্ধ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় বাস করলেও এক এলাকার বানর অন্য এলাকায় প্রবেশ করে না বলে স্থানীয়রা জানান।
দিন দিন মানুষের বসতি বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে বন ও আবাদি জমি। ফলে বানরের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পরছে এসব এলাকা। ফলজ বৃক্ষের পরিমাণও নগণ্য। তাই বন-বাদারে ঘুরে ফিরে খাবে সে উপায়ও নেই বানরগুলোর। খাদ্যের জন্য মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্য এবং চুরি করার উপর নির্ভর করতে হয় এদের। কিন্তু এভাবে যে পেট চলতে চায় না আর! তাই দিন দিন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে লোমশ শরীর। ঝড়-বৃষ্টির দিনে অসহায় এ বানরগুলো একটু মাথা গোঁজার জন্য দিকবিদিক ছুটতে থাকে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সময়টা ১৯৮৮ সাল। চারদিকে থৈ থৈ পানি। ওই বন্যায় সংকটের মুখে পড়ে বানরদল। অসংখ্য বানর মারা যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের বন্যায় দ্বিতীয়বারের মতো বিপন্ন হয়ে পরে বানরকূল। বানের পানিতে ভেসে যায় অনেকে। খাদ্যের অভাবে মারাও পরে। যেখানে মানুষের খাবার নেই সেখানে বানরকে কে দেখবে? ১৯৯৮ এর বন্যায় তৎকালীন পরিবেশ মন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বানভাসি মানুষের পাশাপাশি বানর রক্ষার জন্যও ত্রাণ মঞ্জুর করেছিলেন বলে জানা গেছে।
কোনমতে কেটে যায় সে বছর। বন্যা পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে আবার দেখা দেয় খাদ্য সংকট। বিভিন্ন সময়ে মানুষ বানরগুলোর পাশে এসে দাঁড়ালেও পুরোপুরিভাবে কখনোই খাদ্য সংকট নিরসন করা সম্ভব হয়নি। জীব বৈচিত্রের অন্যতম প্রাণী চরমুগুরিয়া বন্দোরের এই বানরগুলো তাই বিপন্ন হয়ে পরেছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে এদের সংখ্যা। বর্তমানে প্রায় দেড় হাজারের মতো বানর থাকলেও বেশির ভাগই হাড্ডিসার।
এদিকে বন বিভাগ বানরগুলোর জন্য মাদারীপুর সদরের নয়াচর এলাকায় ‘ইকোপার্ক’ নামে একটি অভয়াশ্রম তৈরি করেছে। কিন্তু সেই অভয়াশ্রমে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি বানরগুলোকে। দীর্ঘদিনের আবাস ছেড়ে না যাওয়ার আকুতি এদের। অন্য দিকে এই এলাকার যে কেন্দ্রগুলোতে বানরগুলোকে খাবার দেয়া হতো সেখানে এখন খাবার দেয়া হচ্ছে না। ফলে খাদ্য সংকটে পরে মানুষের বসতবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে বানরদল। কখনো কোন খাবার পেলে ক্ষুধার্ত বড় বানরের হিংস্রতায় খাবারের ভাগ পাচ্ছে ছোটরা। ফলে চিৎকার করে শুধু রাত-দিন কান্না করে বেড়ায় ক্ষুধার্ত শিশু বানরের দল।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ৬ মাস পর পর বানরেরা বাচ্চা দেয়। তবে খাদ্য সংকট থাকায় সেইসব বাচ্চাদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী জুটছে তা জানা যায় না। এখন খাবারের জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠছে বানরগুলো। কেউ কিছু বললে দল বেঁধে হামলা চালাতেও পিছপা হয় না।
ইতোপূর্বে মাদারীপুর সার্কিট হাউসের এক সভায় মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদ চরমুগুরিয়ার বানরদের খাবার দেয়ার বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আগে মাদারীপুর পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকে বানরদের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। তবে এখন বিষয়টি বন্ধ রয়েছে।” বানরগুলোর খাবার বিষয়ে তিনি নৌ-পরিবহন মন্ত্রীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, “চরমুগুরিয়ার এ সকল বানরের জন্য গত বছর ৫ লাখ টাকার খাবার বরাদ্দ হয়েছিল। চলতি বছর শেষ এখনো খাবার বরাদ্দের কোন টাকা আসেনি।”
জনশ্রুতি আছে ষাটের দশকে ভারতের শান্তিপুর ও নদীয়া থেকে অসংখ্য বানর আসে এ বন্দর এলাকায়। তখন বসবাসের উপযোগী হওয়ায় এ এলাকায় থেকে যায় বানরগুলো। কালের বিবর্তনে মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কমে যাচ্ছে বন-জঙ্গল, বাড়ছে বসত বাড়ির সংখ্যা। ফলে দিন দিন অনুপযোগী হয়ে পরছে বানরের বসবাসস্থল। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মাদারীপুরের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য চরমুগুরিয়ার বানররাজ্য আজ বিপন্নতার মুখে।
সংবাদমেইল২৪.কম/জেএইচ/এনএসআর/এএইচকে
Posted ২:৪৩ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.