
বিশেষ প্রতিনিধি,সংবাদমেইল২৪.কম | মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট ২০১৭ | প্রিন্ট
পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক। আকবর হোসেন এবং নিসারুন নেসার ঘরে ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার টালিগঞ্জের নাগতলায় জম্ম নেন তিনি। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট আব্দুর রাজ্জাককে আদর করে পরিবারে ডাকা হতো রাজু, রাজ্জাক বা রাজা নামে।
সর্বপ্রথম কলকাতার শিলালিপি নামে একটি ছবিতে অভিনয় দিয়ে শুরু। ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন খায়রুন নেসাকে (লক্ষ্মী)। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় আসেন। তিন পুত্র-বাপ্পারাজ, বাপ্পি, সম্রাট আর দুই কন্যা-শম্পা, ময়নার বাবা তিনি। রাজ্জাক নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন বেহুলা ছবিতে। তার সর্বপ্রথম প্রযোজিত ছবি আকাঙ্খা আর পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি অনন্ত প্রেম। রাজ্জাক অভিনিত বাংলা উর্দু মিলিয়ে মোট ছবির সংখ্যা প্রায় পাঁচশ।
রাজ্জাক কিশোর বয়সে কলকাতার মঞ্চ নাটকে জড়িয় পরেন। এর পর ১৯৬৪ সালে আলে দাঙ্গার উত্তাল সময়ে নতুন জীবন গড়তে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আবদুর পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক। কঠোর পরিশ্রম আর মেধার স্বীকৃতি হিসেবে উপাধি পান নায়ক রাজ নাজ্জাক। পাকিস্তান টেলিভিশনে ঘরোয়া নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেও জনপ্রিয়তা পান এই নায়ক। তার পর আব্দুল জব্বার খানের সহযোগিতায় তিনি একবাল ফিল্মে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি উজালা ছবিতে কাজ শুরু করেন পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসেবে। এর পর সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশনসহ আরও বেশ কটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করে তিনি। পরে বেহুলা চলচ্চিত্রে সুচন্দার বিপরীতে তিনি নায়ক হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন এবং সবার মন জয় করে নেন।
টালিগঞ্জে জন্ম নেয়া রাজ্জাকের সামনে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিতের মতো তুখোড় অভিনেতারা। সেখানে হালকা-পাতলা সাধারণ রাজুর অভিনয় সুযোগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এর মধ্যে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক সময় কলকাতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন এক সুহৃদ রাজ্জাককে পরামর্শ দিলেন ঢাকায় চলে আসতে। ভদ্রলোক ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা আবদুল জব্বার খানের পরিচিত। তিনি রাজ্জাককে পাঠালেন তার কাছে একটা চিঠি দিয়ে। তিনি রাজ্জাককে বলে দিলেন ঢাকার কমলাপুরে থাকেন আবদুল জব্বার খান। রাজ্জাক প্রথম এসে কমলাপুরে বাসা নেন। এর পর চিঠি নিয়ে জব্বার খানের কাছে যান তিনি রাজ্জাককে একবাল ফিল্ম লিমিটেড এর কাজ করার সুযোগ করে দেন।
উজালা ছবির মধ্যদিয়ে রাজ্জাকের ঢাকার চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয়। পরিচালনার পাশাপাশি বেশ কিছু ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। এরমধ্যে- ডাক বাবু, ১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন, আখেরী স্টেশন উল্লেখযোগ্য। পর্যায় ক্রোমে তিনি জহির রায়হানের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দান করেন। সহকারী হিসেবে কয়েকটি ছবি পরিচালনা করার পর হঠাৎ এক দিন তিনি নায়ক হওয়ার সুযোগ পান। লোক কাহিনি নিয়ে জহির রায়হান তখন বেহুলা ছবির নির্মাণ কাজ করছেন। জহির রায়হান তাকে বললেন, আপনিই আমার ছবির নায়ক। তার বিপরীতে অভিনয় করেন বেহুলারূপী সুচন্দা। বেহুলা ছবিটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। দর্শকের কাছে ছবিটি সুপার হিট হয়। এই ছবির মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পায় আরেক জন নায়ক যিনি চলচ্চিত্র শিল্পের অপরিহার্য নায়ক। ঢাকার সিনাম হলগুলোতে তখন পাক-ভারতীয় ছবির দাপট। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী, জেবা, সুধির, শামীম আরা, ওয়াহিদ মুরাদ এবং কলকাতার ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, বিশ্বজিৎ, সৌমিত্র এবং ভরতের রাজ কাপুর, নার্গিম, দিলীপ কুমার এদের ছবির সঙ্গে পালা দিয়ে চলতে শুরু করল ঢাকার নির্মাতাদের নির্মিত ছবি। আব্দুল জব্বার খান, রহমান, শবনম, খলিল, ফতেহ লোহানী, খান আতা, সুমিতা দেবী, আনোয়ার হোসেন, সুচন্দা তাদের সাথে আরো একটি নাম যোগ হলো আর একটি নাম- রাজ্জাক।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে নির্মিত বেশিরভাগ ছবির নায়ক রাজ্জাক। দুই ভাই, আবির্ভাব, বাঁশরী, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল, দর্পচূর্ণ, যোগ বিয়োগ, ছদ্মবেশী, জীবন থেকে নেয়া, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক।
নিপুন দক্ষতার সাথে রাজ্জাক একের পর এক ছবিতে অভিনয় করে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনিত মানুষের মন ছবি। এটি পরিচালনা করেন মোস্তফা মাহমুদ। এই ছবির মধ্য দিয়ে শুরু হল চলচ্চিত্রে নয়ক রাজ্জাকের যুগ। পরে মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম ছবি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ওরা ১১ জন, এসএম শফির ছন্দ হারিয়ে গেল, বাবুল চৌধুরীর প্রতিশোধ এবং কাজী জহিরের অবুঝ মন ছবিতে অভিনয় করে রাজ্জাক হয়ে যান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আইকন।
১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের রংবাজ ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি সূচনা করেন চলচ্চিত্রের আধুনিক অ্যাকশন যুগেরও। রংবাজ দিয়েই রাজ্জাক তার অভিনয় জীবনে বৈচিত্র নিয়ে আসেন। বেঈমান, অনির্বান, স্লোগান, ঝড়ের পাখি, আলোর মিছিল, এখানে আকাশ নীল, অতিথি, অবাক পৃথিবী, রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি।
১৯৭৪ সালে নতুন পরিচালক মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে একটি গানের দৃশ্যে অভিনয় করেন। এতে নায়ক হিসাবে অভিনয় করে সোহেল রানা, তার জীবনেও এটি প্রথম ছবি।
এক সময় পরিচালক গন মনে করতেন পর্দায় নায়ক মারা গেলে ছবি চলবে না। ঠিক সেই সময় বেঈমান, সমাধি আর সেতু ছবির শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক মৃত্যুবরণ করেন। এতে দর্শকরা খুব কষ্ট পেলেও ছবির সাফল্য ছিল।
১৯৭৭ সালে রাজ্জাক যখন পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। নির্মাণ করেন অনন্ত প্রেম। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন ববিতা। গল্প, গান, চিত্রায়ন, অভিনয় সবকিছু মিলিয়ে দর্শকদের ভালো মানে ছবি উপহার দেন তিনি।
এরপর বদনাম, সৎ ভাই, চাপাডাঙ্গার বউ এবং বাবা কেন চাকর নির্মাণ করে পরিচালক হিসিবে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করেন নায়করাজ। বিশেষ করে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপাডাঙ্গার বউ ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি অভিনেতা রাজ্জাককে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রে শাবানার বিপরীতে এটিএম শামসুজ্জামানকে নেন। এই ছবিটির প্রযোজনা, পরিচালনাও করেন তিনি।
না ফেরার দেশে চলে গেলেন নায়করাজ রাজ্জাক
ব্যাতিক্রমী চরিত্রপ্রেমী রাজ্জাক ১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমানের অশিক্ষিত ছবিতে গ্রামের পাহারাদার চরিত্রে অভিনয় করেন, লুঙ্গি আর শার্ট পরে। এর দুই বছর পর একই পরিচালক আজিজুর রহমানের ছুটির ঘণ্টা ছবিতে স্কুলের দপ্তরির চরিত্রে রাজ্জাকের অসাধারণ অভিনয় চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে দাগ কাটে। দিলীপ বিশ্বাসের জিঞ্জির, মতিন রহমানের অন্ধ বিশ্বাস ছবিতে তার দুর্দুান্ত অভিনয় দর্শক মনে রাখবে বহুকাল।
রাজ্জাকের মৃত্যুতে এফডিসিতে ৩ দিনের কর্মবিরতি
রাজ্জাক ছোটবেলা থেকেই তার ছেলে সম্রাটকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসেন। তার দুই পুত্র বাপ্পারাজ এবং সম্রাটকে নিয়ে এক সঙ্গে অভিনয় করেছেন কোটি টাকার ফকির ছবিতে।
রাজ্জাকের প্রথম জানাজা মঙ্গলবার বাদ জোহর
নিজের এই অবস্থানে আসতে যাদের সহযোগিতা পেয়েছেন তাদের সম্পর্কে এক স্বাক্ষাতকারে নায়করাজ বলেন, “আমার আজকের এই অবস্থানের পিছনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের মধ্য আছেন- আবদুল জব্বার খান, জহির রায়হান, আজহারুল আনোয়ার, নজরুল ইসলাম, আবদুল লতিফ বাচ্চু, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুভাষ দত্ত, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম এবং বন্ধু মজিবুর রহমান চৌধুরী মজনু। এদের সহযোগিতা না পেলে আমি আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না।”
তিনি বলেন, “বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই প্রযোজক-পরিবেশক একেএম জাহাঙ্গীর খানকে যিনি আমাকে শরৎচন্দ্রের গল্প অবলম্বনে দুটি ছবি চন্দ্রনাথ ও শুভদাতে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।”
বন্ধু পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম এই দুই ছবির বাইরেও আমাদে নিয়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নামে একটি সাহিত্য নির্ভর ছবি নির্মাণ করেন।
নায়ক রাজ রাজ্জাক বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলা ২০০৯ তার পুরো পরিবারকে সম্মাননা প্রদান করে।
রাজ্জাকের অভিনিত পরিচালিত ছবি ১৮ টি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছে- অনন্ত প্রেম, মৌ চোর, বদনাম, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে এবং উত্তর ফাল্গুনী। তার নির্মিত সর্বশেষ ছবি হচ্ছে আয়না কাহিনী।
রাজ্জাক শুধু নায়ক হিসেবেই নন একজন পরিচালক হিসেবেও সফল। চলচ্চিত্রের বাইরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার প্রযোজনা সংস্থার নাম রাজলক্ষী প্রোডাকশন।
সংবাদমেইল/এনআই
Posted ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট ২০১৭
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.