সোমবার ২৭ মার্চ, ২০২৩ | ১৩ চৈত্র, ১৪২৯

ধ্রুবতারার দেশে ভালো থেকো শাকির ভাই

সেলিম আহমেদ | মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট ২০২১ | প্রিন্ট  

ধ্রুবতারার দেশে ভালো থেকো শাকির ভাই

শাকির ভাই, তোমাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, কিন্তু কী ভাবে শুরু করব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তোমার সঙ্গে কত গল্প, কত আড্ডা, কতশত স্মৃতি। তুমি আমাদের মাঝে নেই একথা কেন জানি বিশ্বাসই হচ্ছে না। কুলাউড়া থেকে যখন জানলাম তুমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছ সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম আমাদের প্রিয় মোক্তাদির চাচাকে (মোক্তাদির হোসেন)। তিনি জানালেন, আলাউদ্দিন কবির ভাই অ্যাম্বুলেন্সে করে তোমাকে নিয়ে সিলেট যাচ্ছেন। আলাউদ্দিন ভাইকে ফোন করলাম তিনি আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, তোমার অবস্থা খারাপ, দোয়া করতে। এরমধ্যে নাজমুল ভাই, শাহ্ সুমন ভাই, মাহফুল শাকিল ভাইসহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলে তার খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করলাম। রাত ১০টার দিকে আজিজ ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফোন করে বললেন, ‘শাকির আমাদের মাঝ থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেছে’। আজিজ ভাইয়ের কথা বিশ্বাস না করে মছব্বির ভাই, সৈয়দ আশফাক তানভীর ভাই, এমএ কাইয়ুমসহ অনেককে ফোন করলাম তারাও একই কথা বলল। কিন্তু কারো কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। মৃত্যুর খবর জেনেও, ফেসবুকে লিখলাম ‘তুমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছো। সবাই দোয়া করতে।’ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তুমি এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যেতো পারো না। মিষ্টি হাসি নিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। আনন্দ-উল্লাসে মাতিয়ে রাখবে আমাদের। কিন্তু সবাই জানাল, তুমি আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবে না। চলে গেছ সৃষ্টিকর্তার ডাকে।

শাকির ভাই মনে পড়ে তুমি আর আমি কুলাউড়ায় কাছাকাছি সময়ে শুরু করেছিলাম সাংবাদিকতা। ২০১২ সালে আজিজ ভাই সীমান্তের ডাক পত্রিকা করেছিলেন। আমি এর আগে মানব ঠিকানায় কাজ করতাম। আজিজ ভাইয়ের ডাকে সীমান্তের ডাকে এসেছিলাম। আর তোমার সাংবাদিকতার শুরু সীমান্তের ডাক দিয়েই। তখন সীমান্তের ডাকের সম্পাদক ছিলেন আজিজ ভাই (আজিজুল ইসলাম), প্রকাশক এনাম ভাই (মিসবাউর রহমান এনাম)। বার্তা সম্পাদক সঞ্জয় দা (সঞ্জয় দেবনাথ), রিপোর্টার হিসেবে মিন্টু দা (মিন্টু দেশেয়ারা), সাজু মামু (মোয়াজ্জেম সাজু), মোক্তাদির চাচা (মোক্তাদির হোসেন), শাহ সুমন আলম ভাই, শেখ রুহেল ভাই, আব্দুল আহাদ ভাই আর তুমি-আমি ছিলাম সক্রিয়। অল্প সময়েই সীমান্তের ডাক কুলাউড়ার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল। এর পেছনে তোমার অনেক শ্রম-ঘাম লেগে আছে। সীমান্তের ডাক ঠিমের সবাই ছিলাম পরিবারের মতো। এমনও সময় গেছে সারাদিন এক সঙ্গে থাকতাম, শুধু রাতে আলাদা আলাদা ঘুমাতাম। আজ মনে পড়ে, সপ্তাহের রবিবার সকালে পত্রিকা কুলাউড়া পৌঁছলে তুমি নিজ দায়িত্বে সেগুলো মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যেতে ব্রাহ্মণবাজার, বরমচাল আর ভাটেরায়। পৌঁছে দিতে এজেন্টদের কাছে। তোমার লেখা একেকটি রিপোর্ট ঝড় তুলতো কুলাউড়ায়।


২০১৪ সালে নানা মতানৈক্যের কারণে সীমান্তের ডাক থেকে পদত্যাগ করলেন আজিজ ভাই। কিন্তু আমরা থেকে গেলাম প্রাণের সীমান্তের ডাকে। এর কিছুদিন পর আমি ছেড়ে দিলাম সীমান্তের ডাক। আমি ছেড়ে দিছি শুনে তুমি কোনো চিন্তা না করেই বললে, তুমিও থাকবে না সীমান্তের ডাকে। তখন আমরা দুইজন একসঙ্গে মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠালাম। তখন তুমি বাংলাদেশ টুডের প্রতিনিধি, আমি মানবকণ্ঠের কুলাউড়া প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। ইংরেজি দৈনিকে বেশি নিউজ ছাপা হয় না। একটা পত্রিকায় লিখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তুমি। সিলেট ভিউ তখন সিলেটের আলোচিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সিলেট ভিউর ইমরান ভাই (ইমরান আহমদ ও খলিল ভাই (খলিলুর রহমান স্টালিন) ভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। তাদের বললাম, তোমার কথা। তুমি প্রতিনিধি হলে। নিজ কর্ম দক্ষতায় সিলেট ভিউর মন জয় করে নিলে। সিলেট ভিউ-এর প্রাণ হয়ে উঠলে। কুলাউড়া প্রতিনিধি থেকে তোমাকে তারা স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি দিল। সীমান্তের ডাক ছাড়ার পর কুলাউড়া থেকে আজিজ ভাইয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো অনলাইন নিউজ পোর্টাল এইবেলা। এইবেলাও অল্পদিনেই কুলাউড়ার গণমানুষের আস্থা অর্জন করলো। এইবেলা এই অগ্রযাত্রার পেছনে শাকির ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। শুরু থেকে তিনি এইবেলার সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
এই এক দশকে শুধু সীমান্তের ডাক, সিলেট ভিউ কিংবা এইবেলা নয় শাকির ভাই বিভিন্ন সময়ে দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, বাংলাদেশ টুডে, দৈনিক জাগরণ, দৈনিক দেশ, দৈনিক জবাবদিহী দৈনিক সিলেট সুরমার দৈনিক যুগভেরীর কুলাউড়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।

শাকির ছিলেন এক অপাদমস্তক সাংবাদিক। সাংবাদিকতার বাইরে কোনো কিছু চিন্তাও করতে পারতেন না। তাইতো শত প্রতিকূলতার মধ্যে ছাড়তে পারেননি সাংবাদিকতা। এই মাস খানেক আগে বললেন একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এর দুই-তিন দিনের মাথায় দৈনিক নয়াশতাব্দীর সিলেট ব্যুরো প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেলেন শাহ্ শরিফ ভাই। তাকে বললাম, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হিসেবে শাকির ভাইকে যেন নেন। শাহ্ শরিফ ভাই কথা রাখলেন। মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হিসেবে শাকির ভাইকে নিলেন। কিন্তু পত্রিকা বাজারে আসার আগেই চলে পত্রিকাটির শিরোনাম হলেন শাকির ভাই।


শুধু সাংবাদিকতা নয় শাকির ভাই কুলাউড়ার সাংবাদিকদের নেতৃত্বও দিয়েছেন দীর্ঘদিন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে রাজপথে থাকতেন সক্রিয়। আমৃত্যু প্রেসক্লাব কুলাউড়ার নির্বাহী সদস্য, কুলাউড়া সাংবাদিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন।

গত মাসেই সিলেটের সাংবাদিকদের নিয়ে ‘করোনাকালের সাংবাদিকতা’ বিষয়ে ভার্চুয়ালি একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করলো বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম। ফোরামের মহাসচিব ঢাকার বিশিষ্ট সাংবাদিক খায়রুজ্জামান কামাল ভাই বলছেন কুলাউড়া থেকে ২০ জন সাংবাদিকদের তালিকা দিতে। আমি শাকির ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তালিকা দিলাম। শাকির ভাই প্রশিক্ষণও দিলেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে খুব খুশি হলেন। প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার আগেই আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিলেন তিনি।


শাকির ভাই ছিলেন কুলাউড়ার এই সময়ের একজন প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল এক সাংবাদিক, একজন স্বপ্নচারী তরুণ। সবসময় মুখে লেগে থাকতো হাসি। কুলাউড়ার দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে ছিল হৃদিক সম্পর্ক। কখনও কারো সঙ্গে মন খারাপ করতে দেখিনি। কাউকে কখনো শুনিনি তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে। কুলাউড়া থেকে আমি ঢাকায় সাংবাদিকতা করতে যাচ্ছি শুনে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছিলের শাকির। আমি ঢাকায় আসার পর সবসময় খোঁজখবর দিতেন। ফোন দিলে কথা যেন শেষই হতো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম। কখনো কুলাউড়ায় গিয়ে দেখা করে না আসলে ফোন করে রাগ করতেন। সেই ভয়ে দেখা করে আসতাম।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি শাকির ভাই সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করতেন। ভালো কবিতা লিখতেন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কুলাউড়ার নির্বাহী সদস্য ছিলেন। কুলাউড়া উচীদীর আয়োজনে গত বছর বর্ণাঢ্য আয়োজনে বসন্ত উৎসব পালিত হয়। সেই বসন্ত উৎসব আয়োজন উপকমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শাকির ভাই। নান্দনিক সেই আয়োজন প্রশংসিত হয় সবার মাঝে। কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রদলের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে শাকির ভাই রাজপথেও ছিলেন সক্রিয়। বিভিন্ন সময়ে কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

৫ বছরের একমাত্র ছেলেসন্তান গুঞ্জরকে নিয়ে ছিলো শাকির ভাই আলাদা এক পৃথিবী। ফেসবুকে শাকির ভাইয়ের বেশিরভাগ পোস্টের মধ্যে থাকতো বাবা-ছেলের খুনসুটির ছবি। ভাবি সোনিয়া হায়াৎকেও ভালোবাসতেন পাগলের মতো। এই কয়েকদিন আগে ভাবির জ্বর হয়েছিল। তখন তিনি কি দুশ্চিন্তায় ছিলেন তা লিখে বুঝানো সম্ভব হবে না। এই কয়েকমাস আগে মারা গেছেন শাকির ভাইয়ের বাবা। সেই শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি তার পরিবার। এখন শাকির ভাইয়ের মৃত্যুর শোক কীভাবে কাটাবে তারা পরিবার? ভাবি-গুঞ্জর আর শাকির ভাইয়ের পরিবারকে কী বলে সান্ত্বনা দিব সেই ভাষা জানা নেই আমার কিংবা আমাদের কারো। দিন যাবে মাস যাবে-এভাবে বছর যাবো। হয়তো একই শোক একদিন পাথরে পরিণত হবে।

শাকির ভাইকে কুলাউড়ার মনুষ দলমত নির্বিশেষে ভালোবাসতো। তার অকাল মৃত্যুতে কুলাউড়া জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কোনো মানুষই তার এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না। তার মৃত্যু বদলে দিয়ে কুলাউড়ার দৃশ্যপট। বাস্তবতা হলো প্রতিটি মানুষকে একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেটা আজ হোক কিংবা কাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক কবিতায় লিখেছেন ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’ তবুও সময় হল শেষ, তবু হায় যেতে দিতে হল।’ শাকির ভাই হয়তো আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছো চিরদিনের জন্য কিন্তু তার কর্মগুলো কুলাউড়াবাসীর মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে।

টীকা: শুক্রবার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় শাকির ভাই ডায়াবেটিস ও হƒদরোগজনিত কারণে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সহকর্মীরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখানে নেয়ার পর রাত পৌনে ১০ টায় কর্তব্যরত ডাক্তার শাকিরকে মৃত ঘোষণা করেন।

সেলিম আহমেদ। নিজস্ব প্রতিবেদক-দৈনিক মানবকণ্ঠ।

Facebook Comments Box

Comments

comments

advertisement

Posted ৩:৫২ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট ২০২১

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত