শনিবার ২ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ১৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে বিষণ্ণ বাদুড়

রূপা দত্ত | রবিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২১ | প্রিন্ট  

জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে বিষণ্ণ বাদুড়

আমাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের নজরুল, আমাদের লালন, আমাদের প্রাণের সব মানুষের কথা ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠে লম্বা চুলের শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্য মুখায়ব। ছোটবেলায় ছড়া কাটতাম ‘নজরুল তুমি করেছ ভুল, দাড়ি না রেখে রেখেছ চুল’।

আমার বাবার চুল নিয়ে শৌখিনতার কোনো শেষ নেই। কখনও লম্বা, কখনও ছোট, আবার কখনও মাঝারি। কেবল বাবা নন, তার বন্ধুদের অনেককেই এমনটা দেখেছি। লম্বা চুলের পুরুষ হলে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের মনেই আসে- মানুষটা খুব শিল্পমনা। কবি বোধ হয়? নাকি ছবি আঁকে? কিংবা গায়ক হতে পারে! তা নয়তো নির্ঘাত বাউল মনের মানুষ। পুরুষের লম্বা চুল যেন এ দেশের মানুষের আবেগ আর শিল্পমনের সমার্থক। একদিকে বাংলার বাউল-ফকির, সাধু-সন্ত যেমন সাধনার অংশ হিসেবে লম্বা চুল রাখেন, আবার কোনো কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর পুরুষরাও লম্বা চুল রাখেন তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে।

চুল নিয়ে এত সব কথার অবতারণা হলো সম্প্রতি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের ১৪ ছাত্রের চুল কেটে দেওয়ার ঘটনার কারণে। দুষ্টু মনে হঠাৎ উঁকি দিল একটা প্রশ্ন। প্রশ্নটা আমার একার মনে আসেনি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোকজন জানতে চাচ্ছেন- ‘আচ্ছা ফারহানা ম্যাডাম কি যার নামে বিশ্ববিদ্যালয় সেই রবিঠাকুরকে ছাত্র হিসেবে পেলে তারও চুল কেটে দিতেন? ফারহানা ম্যাডাম কিন্তু তার কোনো ছাত্রীর চুল কাটলেন না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ‘ছেলেদের চুল ছোট রাখতে হবে’ এই জেন্ডার স্টেরিওটাইপ ভাবনার বাইরে আসতে পারলেন না, এটা আমাকে ব্যথিত করেছে। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক, তাও আবার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বেমালুম ভুলে গেলেন, এই দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যজুড়ে আছে নারী-পুরুষ সবার চুল লম্বা রাখার ইতিহাস।

সাম্প্রতিককালে আরও একটি আলোচিত ঘটনা হলো লুঙ্গি পরে অনলাইনে পরীক্ষায় বসার অপরাধে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রের বহিস্কারাদেশ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, ছাত্ররা ‘অশালীন’ পোশাক পরেছে এবং এ বিষয়ে শিক্ষকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ কাজ করেছে বলে তারা বহিস্কৃত হয়েছেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ, যিনি ছিলেন কৃষক নেতা, যার সম্মানার্থে নামকরণ করা হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেখানে ঘটেছে এ ঘটনা। এ দেশের কৃষকের পোশাকই হলো লুঙ্গি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ কি লুঙ্গি পরতেন না? মনে পড়ছে, বছর দুয়েক আগে ঢাকার বারিধারায় নিয়ম করা হলো, লুঙ্গি পরে রিকশা চালানো যাবে না, এতে নাকি ওই এলাকাবাসীর মানসম্মানের দারুণ ব্যাঘাত হয়!

আমার এক বড় ভাই পাহাড়ে চরে বেড়ানোর জন্য মাঝেমধ্যেই নেপালে যেতেন। একবার তার ইচ্ছা হলো, লুঙ্গি পরে বিমানে চড়বেন। যেই ভাবা সেই কাজ। এয়ারপোর্টের যাবতীয় নিয়মকানুন সেরে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে বিমানে ওঠার সময় বাধাপ্রাপ্ত হলেন। বিমান কর্তৃপক্ষ তাকে কিছুতেই উঠতে দেবে না, যেহেতু বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ফেলেছেন, তাই তাকে ফেলেও যেতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত তিনি লুঙ্গি পরেই বিমানে উঠেছিলেন, কেননা লুঙ্গি পরে বিমানে চড়া যাবে না, এমন কোনো বিধিনিষেধ তারা দেখাতে পারেননি।

মওলানা ভাসানী লুঙ্গি পরেই রাজনীতি করে গেছেন, গণমানুষের নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ কিংবা মওলানা ভাসানী তো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিই হতে পারতেন না। ফরম তুলতে এলেই বাতিল হয়ে যেতেন, আর বাতিল করার যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক করতে গেলেই হয়ে যেতেন কালো তালিকাভুক্ত।

চুল লম্বা রাখা, লুঙ্গি পরা- এ দুটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে প্রথম ভাবনাটি আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষা দেবেন, তাদের একটি অংশের মাঝে নিজের সংস্কৃতি নিয়ে রয়েছে দারুণ হীনম্মন্যতা। যে ব্যক্তি তার নিজের শিকড় উপড়ে ফেলতে চান, তার শিক্ষাদান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি। এই শিক্ষকদের মাঝে রয়েছে নিজ দেশের সংবিধান এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালার প্রতি অশ্রদ্ধা। এদের আচরণে প্রকাশ পায়, ব্রিটিশের শাসনের প্রভাব এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি অসম্মান। উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে একজন ব্যক্তি কেমন পোশাক পরবেন, কেমন করে চুল কাটবেন সেটি রাষ্ট্র নির্দিষ্ট করে দেয়নি। এ দেশের সংবিধানে ব্যক্তির স্বাধীনতার কথা বলা আছে, বলা আছে মতপ্রকাশের অধিকারের কথা। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ এই ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’র পরিধি শুধু পুরুষের চুল লম্বা রাখা এবং ছাত্রের লুঙ্গি পরে পরীক্ষা দিতে চাওয়ায় সীমাবদ্ধ নয়।

বিশ্বব্যাংকের করা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান শুরু হয়েছে ১৫০০-এর পরে। আর এশিয়ার প্রথম ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। শিক্ষার মান উন্নয়নের চেয়েও শিক্ষার্থীর বহিরাবরণ কেমন হবে তা যখন মুখ্য হয়ে ওঠে, সেখানে পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। এসব শিক্ষক ভুলে যান বিশ্ববিদ্যালয় মানে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর বিবিধ বিষয়ে যুক্তিতর্ক, পরস্পরের কাছ থেকে জানা ও শেখা। একটি বড় অংশের শিক্ষকদের পশ্চাৎপদ রক্ষণশীল অগভীর মনোভাব জাতিকে শঙ্কিত করে। এসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিবেচনা করেন গাধার পাল হিসেবে, যারা কেবল পাতার পর পাতা মুখস্থ করে যাবে, তারপর ঘাড় গুঁজে কেরানির কাজ করে যাবে আজীবন। এ শিক্ষকরা বানাতে চায় একটি মেরুদণ্ডহীন জাতি।

কথা হচ্ছিল এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বন্ধুর সঙ্গে। তিনি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতাকে এর জন্য দায়ী করেন। কেবল ভালো ফলাফলকে বিবেচনায় রেখেই শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, আর বিভিন্ন ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা বাদ দেওয়া গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে তার ফলাফলের পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে সংবেদনশীলতা; সব মতামত, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান এবং উদারনৈতিকতা- এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। প্রায় অর্ধশত বছর আগে কবি আল মাহমুদ তার সোনালি কাবিনের একটি সনেটে যেন আজকের এই পরিস্থিতির কথাই বলে গেছেন, ‘আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে/অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা’। সত্যি ‘জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ণ বাদুড়’।

মানবাধিকার কর্মী

উৎস : সমকাল

Facebook Comments Box

Comments

comments

advertisement

Posted ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২১

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত