বিশেষ প্রতিনিধি,সংবাদমেইল২৪.কম | মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট
কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের কানাইটিকর গ্রামের রব উল্লাহ (৬৫) প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন। ঘর পেয়ে খুশি হতে পারেন নি।
প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইতা ঘর দিয়া কিতা করতাম, তুফান (ঘূর্নিঝড়) লাগতো নায়, সামান্য বাতাসে উড়াইয়া নিবো গিয়া। কাজ অত নিম্নমানের অইছে, এই ঘর কয়দিন টিকবো আল্লায় জানইন। তিনি আরও বলেন, মেসতইর (মিস্ত্রি) হকলরে কইলে তারা উল্টা ঝাড়ি মারিয়া কইন, যেখান পাইছইন অখানউ নেউক্কা।
একই ইউনিয়নের সুজাপুর গ্রামের রুমেনা বেগম (৩০) জানান, ঘরটা বানাইতে অত খারাপ কাম করছইন, একজরা বাতাস দিলেই লড়ে (নড়ে)। খুটা গাড়ার (পুতা) কথা ৩ ফুট। কিন্তু এক দেড়ফুট গাড়া অইছে কিনা সন্দেহ আছে।
গনিপুর গ্রামের আব্বাস আলী ও আব্দুল আহাদ জানান, মাত্র এক মাসের মধ্যে ঘরের নিচ (ফ্লোর) ফেটে গেছে। যারা কাজ করছে তারা ২০ টুকরি বালির সাথে এক বস্তা সিমেন্ট দিছে। এর লাগি এই অবস্থা।
উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের রঙ্গিরকুল গ্রামের কয়েছ মিয়া জানান, ঘরের কাজে লাকড়ি (কাট) বাজে ব্যবহার করা অইছে। দুর্বল খুঁটি দিছে। বাতাসে সিমেন্টের খুঁটিগুলো ফাটি (ফেটে) যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পৃথিমাপাশা ইউনিয়নের গনিপুর গ্রামের পাকাঘর নির্মাণ শ্রমিক আজহারুল ইসলাম জানান, আমি নিজে এসব কাজ করি। কিন্তু আমারে যে ঘরটা দেয়া অইছে তা এক্কেবারে নিম্নমানের। এক লাখ টাকাতো দুরের কথা এসব ঘর নির্মাণে ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও বেশি হবে।
কুলাউড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি আশ্রয়ন প্রকল্প-২ ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ’ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের এমন চিত্র সরেজমিন পরিদর্শণকালে ধরা পড়ে। উপজেলায় মোট ৩০০ ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দরিদ্র এসব মানুষের ঘর নির্মাণ করে দেয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে পরিবহন খরচও নেয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সরকার প্রতিটি কাঁচা ঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ঘর নির্মাণ শেষে বাড়তি টাকা সুবিধাভোগীদের ফেরত দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি এ টাকা। প্রকল্প থেকে লুটপাটের জন্য ঘর নির্মাণে প্ল্যান, ডিজাইন প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগত মান বজায় রাখা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ঘরপ্রাপ্ত অসহায় মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের সম্পূর্ন টাকা ব্যয় করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সম্পূর্ন টাকা ব্যয়ে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হত, তাহলে অসহায় দুস্থ ও পুণর্বাসিত ব্যক্তিদের স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হত।
উপকারভোগিরা আরও জানান, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিনামূল্যে পাওয়া ঘরের মেঝেতে আমাদেরকে মাটি ভরাট করতে বাধ্য করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িতরা। এজন্য ধার-দেনা করে গুনতে হয়েছে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। মাথাগোজার একমাত্র গৃহটি যাতে সুন্দর হয় সে জন্য কর্তব্যরত কর্তাদের কথামত ঘর নির্মাণকারী শ্রমিকদের নিয়মিত ২ বেলা এমনকি কখনও কখনও ৩ বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে উপার্জনে অক্ষম পরিবারদের। পিলারে থাকবে ছয় এমএম গ্রেড রড (চারটি)। কিন্তু নন-গ্রেড রড ব্যবহার করা হয়েছে। পিলালের রড বাঁধাইয়ে রিং (চুড়ি) হিসেবে রডের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ৮ নম্বর জিআই তার। তৃতীয় শ্রেণির ইটের খোয়া (ডাস্টসহ) দিয়ে পিলার বানানো হয়। পিলার ঢালাই শেষে চটের মাধ্যমে ১৪ থেকে ২১ দিন পানি দেয়ার (কিউরিং) কথা। কিন্তু সেখানে চটের বস্তা ব্যবহার করা হয়নি, দেয়া হয়নি ঠিকমত পানিও। প্রতি ফুটে একটি করে রিং দেয়ার কথা থাকলেও ১৬ ইঞ্চি পর পর লাগানো হয়েছে রিং।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত নকসাঁ ও প্রাক্কলন থেকে জানা গেছে, প্রতিটি ঘরের মেঝে ১৫০ মিলিমিটার বালি দেয়ার পর ডাবল লেয়ার পলিথিনের উপর ঢালাই দিতে হবে। সরজমিনে গিয়ে তার কোন মিল পাওয়া যায় নি। প্রতিটি দরজা ও জানালায় রং করার কথা উল্লেখ থাকলেও তা করা হয় নি। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসনের দুই বড়কর্তা নিয়োগ দেন নিজেদের পছন্দসই ঠিকাদার। যাদের বাড়ি সাভার ও খুলনায়। তাদের নিয়োগকৃত রাজমিস্ত্রি ও কাঠমিস্ত্রিরা ইচ্ছে মতো কাজ করছেন। কাজে আপত্তি জানালে উপকারভোগিদের সাথে খারাপ আচরণ করেছেন। সিডিউলে ১৭৫ বর্গফুট আয়তনের একটি ঘরে ৪ বর্গ ইঞ্চি ১২টি পিলারের উচ্চতা ১২ ফুট। মূল ঘর ও বারান্দা এবং ল্যাট্টিনে ৯টি খুঁটি ১০ ফুট ৬ মিলি ৪টি করে রড দেয়ার নিয়ম থাকলেও ১২টি পিলার ১০ ফুট করে এবং ৯টি পিলার ৮ ফুট করে ৬ মিলি. রডের স্থলে ৪ মিলি. ৩টি করে রড এবং রিং ৪ মিলি. রডের পরিবর্তে মোটা তার ও নিম্নমানের ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। ৪টি জানালায় লোহার গ্রিল দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। ঘর ও বারান্দার মেঝে সিসি ঢালাই ৩ ইঞ্চি ধরা থাকলেও ১-২ ইঞ্চি দিয়ে ঘরের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। পিএল এর ইটের গাথুনি ১ফুট ৯ ইঞ্চি করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে করা হচ্ছে ১ ফুট এবং ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ইট ও খোয়া। এছাড়া ল্যাট্রিন নির্মাণে ৮টি করে রিং স্লাব ব্যবহারের কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে ৫-৬টি করে রিং-স্লাব।
নীতিমালা অনুযায়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ পিআইসির মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কাজ করার কথা থাকলওে পিআইসির সভাপতি (ইউএনও) একক ক্ষমতাবলে তার পছন্দের লোকজনকে দিয়ে কাজ করান। পিআইসির অন্য সদস্যরা হলেন- উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন র্কমর্কতা (পিআইও), সদস্য সচবি (উপজেলা প্রকৌশলী), উপজলো সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, নীতিমালা অনুযায়ি চেয়ারম্যানরা পদাধিকার বলে কমিটির সদস্য হলেও, কাজে কিংবা তালিকা করার সময় তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তবে বরমচাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আহবাব চৌধুরী জানান, তালিকা করার সময় কিংবা কাজ করার কিছুই আমরা জানি না। যখন জানলাম তখন দেখি এক ওয়ার্ডে ৩টা আরেক ওয়ার্ডে ৭টা। ঘর নিয়া এখন আমি পড়ছি বিপাকে। প্রকল্প নীতিমালায় পিআইসির মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) কাজটি করার কথা থাকলে সভাপতি তা করেননি।
ইউএনওর মনোনীত ঠিকাদার রাজিব মন্ডল জানান, সবকিছু জানেন ইউএনও। তিনি সব বলতে পারবেন। আমি শুধু টিন কিনে দিয়েছি। এই রাজিব মন্ডল একেক সময় নিজের বাড়ি খুলনা আবার একেক সময় ঢাকা মিরপুর বলেন। কাজে অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব ইউএনও সাহেব বলবেন।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুল লাইছের সাথে ফোনে (নং ০১৭৩০৩৩১০৭৪) একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ন প্রকল্প-০২ প্রকল্পের উপ-পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এসএম হামিদুল হক জানান, এ প্রকল্পটি উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা বাস্তবায়ন করেন। কাজে কোন অনিয়ম হলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেবো।
Posted ৩:০১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৯
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.