শনিবার ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১৫ আশ্বিন, ১৪৩০

কুলাউড়ায় ঠিকাদার কোকিলের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত চলছে

বিশেষ প্রতিনিধি,সংবাদমেইল২৪.কম | সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট  

কুলাউড়ায় ঠিকাদার কোকিলের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত চলছে

মুহিবুর রহমান কোকিল। কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে বিএনপির নেতা। ছাত্রজীবনের গন্ডি পার হওয়ার পরপরই নিজেকে জড়িয়ে নেন ঠিকাদারি ব্যবসায়। ঠিকদারি লাইসেন্স নয়, যেন তিনি হাতে পান ‘আলাদিনের চেরাগ’।

রাতারাতি পাল্টে যায় তার জীবনচিত্র। সরকারি কর্মকর্তা ও কতিপয় রাজনীতিকদের সাথে সিন্ডিকেট করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে তিনি এখন বিপুল অর্থের মালিক। ইতোমধ্যে কুলাউড়া অঞ্চলের সড়ক ও জনপথের কাজে অনিয়মের কারণে দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয় তার মূল ঠিকাদারি লাইসেন্স। কিন্তু থেমে যাননি কোকিল।


সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে কুলাউড়ায় এলজিইডি বিভাগের অধীনে রাস্তার কাজে ব্যাপক অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী রাস্তার কাজ বন্ধ করে রাস্তার নিম্নমানের কার্পেটিং তুলে দেয়। এ সময় স্থানীয় জনতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম আর ট্রেডিংয়ের ঠিকাদার মুহিবুর রহমান কোকিল, তার সহযোগী ঠিকাদার আব্দুল হাকিম বাচ্চু ও উপজেলা প্রকৌশলী ইসতিয়াক হাসানকে প্রকাশ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে কাজের অনিয়মের বিষয় কৈফিয়ত চায়।

এদিকে ঠিকাদারি লাইসেন্স পেয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মুহিবুর রহমান কোকিলের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে তারা ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিল, বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়ম রোধসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কুলাউড়ার জয়চন্ডী ইউনিয়নের গৌরীশংকর গ্রামের সিরাজুল ইসালম ও হাবিব খান।


তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী তাৎক্ষণিক তদন্ত করে গুরুত্বে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার দুপুরে এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক দফতরের ডেপুটি টিম লিডার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি তদন্তকারী দল সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এতে বেশ অনিয়মের চিত্র পেয়েছেন বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সংশ্লিষ্ট সূত্র।

সূত্র জানায়, কুলাউড়া উপজেলার পুশাইনগর বাজার থেকে ভূকশিমইল পর্যন্ত আট কিলোমিটার রাস্তার মেরামত বাবদ ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম আর ট্রেডিংয়ের মালিক মুহিবুর রহমান কোকিল। কাজটি বাস্তবায়নের শুরুতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্যাপক অনিয়ম শুরু করে।


গত ১৪ নভেম্বর গৌরীশঙ্কর এলাকায় সরেজমিন কাজের অনিয়ম দেখে বেলা সাড়ে ১১টায় কাজ বন্ধ করে দেয়। প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ বন্ধ রাখার পর কুলাউড়া উপজেলা প্রকৌশলী মো. ইশতিয়াক ও ঠিকাদার মো. মুহিবুর রহমান কোকিল ঘটনাস্থলে যান। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের ঘেরাও করে রাখে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাস্তা কার্পেটিং করে যাওয়ার পর কেউ হাত দিয়ে টান দিতেই কার্পেটিং উঠে আসে। আবার পা দিয়ে খোঁচা দিলে তা উঠে যায়। এত নিম্নমানের কাজ কোনো রাস্তায় হয়নি। গাড়ি চলাচল করলেই পিচ উঠে যাবে। কাজ চলাকালে ঠিকাদারদের কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার অফিসের কোনো লোকজন উপস্থিত থাকে না। ফলে শ্রমিকরা তাদের ইচ্ছামতো কাজ করে। কোথায়ও আধা ইঞ্চি আবার কোথায় এর চেয়ে কম পিচ ঢালাই করা হচ্ছে। এ সময় রাস্তার উভয় পাশে গাড়ি আটকে রাখায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা পাশ কাটিয়ে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। এ সময় স্থানীয় এলাকাবাসী ঘেরাও করে রাখে। খবর পেয়ে কুলাউড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। পরে রাস্তার কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনের প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষুব্ধ জনতা শান্ত হয় এবং অবরোধ তুলে নেয়।

সম্প্রতি শুরু হয়েছে কমলগঞ্জ-মুন্সিবাজার সড়কের মেরামত কাজ। প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ কিলোমিটারের এ রাস্তার মেরামত কাজে পুরাতন কংক্রিট (ইটের খোয়া) ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।

এর আগে ২০১৮ সালে বিয়ানীবাজার-চান্দরপুর সড়কের সংস্কার কাজেও অভিযোগ ওঠে ঠিকাদার কোকিলের বিরুদ্ধে। সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার আগেই সড়কজুড়ে দেখা দিয়েছে ফাটল। সড়কের খোয়া উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট গর্ত। সড়কের সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার আগেই সড়কে কেন ফাটল দেখা দিয়েছে, এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাতে শোকজ করেন বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রকৌশলী রামেন্দ হোম চৌধুরী।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অবহেলার সুযোগে সড়ক সংস্কারে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিটুমিন দিয়ে কার্পেটিং শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মুহিবুর রহমান ট্রেডার্স। খোয়া উঠতে থাকে, সড়কজুড়ে দেখা দেয় অসংখ্য ফাটল।

উপজেলা প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা যায়, বিয়ানীবাজার-চান্দরপুর সড়ক সংস্কারের জন্য ২০১৭ সালের শেষ দিকে সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার অংশে সংস্কার কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মুহিবুর রহমান ট্রেডার্সকে। এতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

ওই বছর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিডি)-এর আওতায় কুলাউড়া-ভূকশিমইল সড়কে সংস্কার কাজের মাত্র তিন মাসের মাথায় প্রায় অর্ধকিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে কার্পেট (পিচ ঢালাই) ধসে পড়ে বড় বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। এ কাজটিরও ঠিকাদার ছিল মো. মুহিবুর রহমান কোকিলের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম আর ট্রেডিং।

কুলাউড়া-ভূকশিমইল সড়কে ভূকশিমইল ইউনিয়নের প্রবেশদ্বার পালের মোড়া-কানেহাত গোগালী ছড়া ব্রিজ থেকে কানেহাত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন রাস্তার বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধকিলোমিটার দেবে যায়। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংক (আইডিএ) অর্থায়নে সেকেন্ড রুরাল ট্রান্সপোর্ট ইমপ্রুভমেন্ট (আরটিআইটি-২) প্রকল্পের মাধ্যমে এ কাজের দায়িত্ব পায় মো. মুহিবুর রহমানের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম আর ট্রেডিং। কাজ সমাপ্তের মেয়াদ প্রায় ৩ মাস আগে এই অংশের কাজটি সমাপ্ত করে এ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নতুন কার্পেটিং (পিচ ঢালাই) কাজের তিন মাস যেতে না যেতেই আচমকা মূল সড়ক থেকে প্রায় ৪-৫ ফুট জায়গা দেবে গিয়ে বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে।

কুলাউড়া-চান্দগ্রাম ভায়া বড়লেখা সিঅ্যান্ডবি সড়কের সংস্কার কাজেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সড়কের উভয় পাশে ড্রেন ও গার্ডওয়াল নির্মাণকাজে ব্যবহার করেন নিম্নমাণের ইট। সড়কটির হাতলিঘাট, সফরঘাট, কাঁঠালতলী ব্রিক ফিল্ড সংলগ্ন এলাকার ড্রেন ও গার্ডওয়ালে এসব নিম্নমানের ইট ব্যবহার করেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ চলাচলে সড়ক ও জনপথের কোনো কর্মকর্তা কাজ পরিদর্শনে আসেননি। যার ফলে ঠিকাদার তার মনগড়া কাজ করেই চলে গেছেন। এলাকাবাসীর আপত্তির কোনো কর্ণপাত করেননি। তারা চ্যালেঞ্জ করে বলেন, এখনো যদি কাজ তদন্ত করা হয় তাহলে নিম্নমানের ইটের অস্তিস্ত পাওয়া যাবে। সড়কটির সংস্কারকাজেও সরকারি প্রাকৃতিক টিলা ধ্বংস করা হয়।

মৌলভীবাজার-কুলাউড়া-চাতলাপুর সড়কের মেরামত কাজে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তোলেন মৌলভীবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান রনি। অনিয়মের চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, সড়কে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরাতন এবং টেম্পারহীন। পাথর দেওয়ার পর দেওয়া হয়নি পানি ফলে পাথর ঠিকমতো বসেনি। ঠিকাদার কোকিলের মনমতো কাজ করার কারণে সরকারের উন্নয়নধারা ব্যাহত হয়। প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে এ রাস্তাটিতে।

এছাড়াও কুলাউড়া-চান্দগ্রাম ভায়া বড়লেখা সিঅ্যান্ডবি ও মাধবকু- জলপ্রপাতের সড়ক সংস্কারের নামে এক্সেবেটর দিয়ে কেরামত নগর চা-বাগানের শতাধিক চা-গাছসহ টিলা কাটাসহ বিভিন্ন রাস্তার মেরামত ও নির্মাণকাজে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কোকিলের বিরুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার এলজিইডির প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদার জানান, এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক দফতরের ডেপুটি টিম লিডার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি তদন্তকারী দল সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা ঢাকায় গিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দেবে।

তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন মহল থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আসা অন্যান্য অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Facebook Comments Box

Comments

comments

advertisement

Posted ৪:৪৭ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত