
বিশেষ প্রতিনিধি,সংবাদমেইল২৪.কম | বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০ | প্রিন্ট
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় লোহাইউনি চা বাগানে বাগানের শ্রমিক নেতা কর্তৃক নারী চা শ্রমিকসহ তার পরিবারের সদস্যদের মারধর করে এবং বসতঘর ভেঙে বাগানের আরেকটি শ্রমিক বস্তিতে বসবাস অনুপোযোগি ঘরে স্থানান্তর করার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর থেকে ওই নারী শ্রমিক শান্তি রবি দাস দুই কন্যা সন্তান,এক ছেলে ও স্বামীসহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন।
বিষয়টি থেকে পরিত্রাণ পেতে ঘটনার শিকার ওই নারী চা শ্রমিক শান্তি রবি দাস ১৩ জুলাই কুলাউড়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে হামিম গ্রুপের মালিকানাধীন উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নে অবস্থিত লোহাইউনি (হলিছড়া) চা বাগানে।
অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি অজিত কৈরী ও সাধারণ সম্পাদক রবি সিং ভৌমিজ গ্রুপের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্ধ রয়েছে। ঘটনার শিকার শান্তি রবি দাস ওই বাগানের নিয়মিত শ্রমিক এবং পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি অজিত কৈরীর আত্মীয়। এজন্য প্রায়ই সাধারণ সম্পাদক রবি সিং ভৌমিজের ইন্দনে বাগানের কিছু শ্রমিকরা শান্তি রবি দাসের পরিবারের ওপর অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ এনে হুমকি দিয়ে আসছিলো।
গত ১১ জুলাই শান্তি রবি দাসের ছোট ছেলে সুমন রবিদাসের (৯) সাথে প্রতিবেশি রানা মাহালীর জিঠুর মাহালীর (৯) মারধরের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি বাগান বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রবি সিং ভৌমিজকে জানালেও রাতে আবারো ঘরে ঢুকে শান্তি রবি দাসের বড় মেয়ে সুমি রবি দাসকে মারধর ও হুমকি দেয়। পরদিন বাগানের সহকারি ব্যবস্থাপকের কথা বলে এবং বিষয়টি সমাধানের কথা বলে রবি সিং শান্তি রবি দাস ও তার সন্তানদের অফিসে ঢেকে নিয়ে যায়। এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য সত্য নাইডু। সেখানে যাওয়ার পর তাদের ওপর উল্টো অভিযোগ এনে উপস্থিত রবি সিং ভৌমিজের সহযোগিরা শান্তি রবি দাস, বড় মেয়ে সুমি রবি দাস, ছোট মেয়ে শিউলী রবিদাস ও ছেলে সুমন রবিদাসকে টেনে হিচড়ে অফিসের সামনে মারধর করে। এতে গুরতর আহত হয় শান্তি রবি দাসের ছোট মেয়ে শিউলী। গুরুতর আহত অবস্থায় শিউলিকে কুলাউড়া হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। এদিকে তাঁদেরকে মারধর করে রবি সিং ভৌমিজের নের্তৃত্বে দিলীপ পাশী, অনন্ত সিং ভৌমিজসহ বেশ কয়েকজন লোক মন্ডপটিলায় অবস্থিত শান্তি রবি দাসের বাড়িতে গিয়ে ঘর ঢুকে আসবাবপত্র বাহিরে ফেলে দিয়ে ভাঙচুর চালায়। এবং হুমকি দিয়ে সেখান থেকে তাঁর স্বামীসহ সবাইকে ওই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরে বাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের সাতঘর এলাকায় অন্য একটি বস্তিতে জরাজীর্ণ একটি ঘরে শান্তি রবি দাসের পরিবারকে স্থানান্তর করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শান্তি রবি দাস ও তাঁর স্বামী মানিক রবি দাস সন্তানদের নিয়ে বাগানের সাতঘর এলাকার একটি বস্তিতে জীর্ণ ঘরে মানবেতরভাবে বসবাস করছেন। ওই ঘরে নেই বিদ্যুত। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে ঘরে। মেঝে অস্বাস্থ্যকর ও স্যাতস্যাতে। এরই মাঝে গত ৫ দিন ধরে কোনরকম ওই ঘরে বাস করছেন তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিকরা জানায়, বাগানের কোন শ্রমিক ও তাঁর পরিবার কোন অন্যায় কাজ করলে শাস্তি মূলক ওই ঘরে বসবাসের জন্য স্থানান্তর করা হয়। এসময় শান্তি রবি দাস ও তাঁর স্বামী মানিক রবি দাস বলেন, আমাদেরকে এখানে দেওয়ার আগে ওই ঘরে যে শ্রমিক থাকতো তাঁকে আমাদের ঘরে দেওয়া হয়েছে। এবং আমাদেরকে এই ঘরে দেওয়া হয়েছে। আমাদেরকে মারধর করলো আবার জোর করে আমাদের এই ভাঙা ঘরে দেয়া হলো। এই ঘরের বৃষ্টির পানি পড়ে। দরজা জানালা ভাঙা। আগে যারা থাকতো তারা ঘরের ভিতর একরুমে গরু রাখতো অন্যরুমে তাঁরা থাকতো। তাই ঘরের মেঝে খুব স্যাঁতস্যাঁতে। কোনভাবে সন্তানদের নিয়ে একরুমে আছি। গোসলখানা ও পাকঘর ভাঙা। তাই রান্না করতে পরছিনা। সম্পাদকের পক্ষে অধিকাংশ শ্রমিক থাকায় বাগান কর্তৃপক্ষও তাঁদের পক্ষ নিয়ে আমাদেরকে উল্টো এমন শাস্তি দিচ্ছে। আমাদের প্রতি এ কেমন অবিচার।
তাঁরা আরো বলেন, কয়েক বছর আগে আমাদের বড় মেয়ে সুমির সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সভাপতি অজিত কৈরীর সাথে। গত বছর অজিত ও সুমি বিয়ে করে। এ ঘটনায় আমাদের মেয়েকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে বিয়ে করায় থানায় একটি মামলা দায়ের করি এবং সে মামলায় অজিত কিছুদিন জেল খাটে। পরবর্তীতে দুই পরিবার বিয়ে মেনে নেওয়ায় আমরা মামলাটি তুলে নেই। কিন্তু কমিটির দ্বন্ধের জেরে রবি সিং ভৌমিজ ও দিলীপ আমাদেরকে চাপ দেয় অজিতের বিরুদ্ধে মামলা করতে। মামলা না করলে সমাজ থেকে বিচ্যুত করে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসতো প্রতিনিয়ত। এরই জের ধরে পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করে আমাদের ঘর থেকে বের করে দেয়।
অভিযোগের ব্যাপারে রবি সিং ভৌমিজের মোবাইলে ফোন দিলে তিনি মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, অজিত বছরখানেক আগে শান্তি রবি দাসের মেয়েকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। বিষয়টি তাঁদের সমাজ মেনে নেয়নি। এজন্য শ্রমিকরা তাঁদের ওপর অভিযোগ তুলে।
তাঁদেরকে স্থানান্তরের বিষয়ে বলেন, সাতঘর এলাকার ওই ঘরে আগে পূরণ মালি নামে এক শ্রমিক ও পরিবার ছিলো। তাঁকে অনেকবছর আগে চুরির অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের সাতঘর এলাকায় একটি ঘরে স্থানান্তর করেছিলো। এখন তাদের শাস্তি ভোগ শেষ হওয়ায় ওই পরিবারকে বাগানের মন্ডপটিলায় শান্তি রবি দাসের ঘরে স্থানান্তর করা হয় এবং শান্তি রবি দাসকে সাতঘর এলাকার ওই ঘরে স্থানান্তর করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে বাগানের ব্যবস্থাপক মাহমুদ আলীর অফিসে গেলে সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে বাগানের কর্মচারী মোবাইলের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক মাহমুদ আলীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ছোটদের দ্বন্ধ নিয়ে ঘটনার সুত্রপাত। পরদিন দুই পক্ষ সমাধানের জন্য অফিসের সামনে আসেন। এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ শ্রমিকের দাবির প্রেক্ষিতে শান্তি রবি দাসের পরিবারকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়।
জরাজীর্ণ ঘরে স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতদিন আরেকজন শ্রমিক তাঁর পরিবার নিয়ে ওই ঘরে থেকেছে। সে কেন পারবেনা।
অভিযোগ দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করে কুলাউড়া থানার এস আই পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, পূর্ববিরোধের ঘটনার জেরে পঞ্চায়েত কমিটির আবারো এই ঘটনাটি ঘটে। শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে শান্তি রবি দাসের পরিবারকে বাগানের অন্য একটি এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। গতকাল বুধবার আমি বাগানে ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। বিষয়টি বাগান কর্তৃপক্ষের তাই তারাই এটা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আমি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সুরাহার জন্য বলবো।
Posted ৪:৫২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.