
বিশেষ প্রতিনিধি,সংবাদমেইল২৪.কম | রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ণ প্রকল্প-২ এর কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের সংবাদ বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশের পর তৎপর হয়ে উঠেন সংশ্লিষ্টরা। নিম্নমানের কাজ ঢাকতে তড়িঘড়ি করে ঘরের ফাটা অংশে সিমেন্টের প্রলেপ দেয়া শুরু হয়েছে। আর এসব বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার জন্য উপকারভোগিদের নিষেধ করেন ভরাট কাজে নিয়োজিত মিস্ত্রিরা।
শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকেলে সরজমিন ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ঘরে নতুন করে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে ফ্লোর ও খুটির ফাটা অংশ ভরাট করা হয়েছে।
উপকারভোগি হাবিবুন বেগম বলেন, ঘরের কাজ একেবারে নিম্নমানের হয়েছে। ঘরের মেজেতে পাড়া দিলে ভেঙ্গে যাচ্ছে ফ্লোর। পায়ে সাথে ফ্লোরের ভাঙ্গা অংশ উঠে আসছে। নতুন সিমেন্টের প্রলেপের বিষয়ে তিনি বলেন, আপনারা আসার কিছুক্ষন আগে দু’জন লোক এসে সিমেন্ট দিয়া ফাটাগুলো ভরাট করেছে। এ বিষয়টি নিয়ে কাউকে কিছু না বলতেও বলে গেছে।
আরেক উপকারভোগী খালেদা বেগমের ঘরের অবস্থা খুবি নাজুক। ঘরের ভেতরের সিংহভাগ অংশ ফেটে চৌচির। নাম মাত্র ঘরের বারান্দার ও খুটির ফাটা অংশে সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দিয়েছে মিস্ত্রিরা। সাথে ফাটার বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে নিষেধও করা হয়েছে। এই এলাকার হাবিবুন বেগম, সমুজ মিয়া ও খালেদা বেগমের ঘরেও একইভাবে সিমেন্টের প্রলেপ দেয়া হয়েছে।
কুলাউড়ার চলমান প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ’ কাজে করা হয়েছে সীমাহীন অনিয়ম। যার নেতৃত্বে আছেন কুলাউড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল লাইছ। প্রকল্প থেকে লুটপাটের জন্য ঘর নির্মাণে প্ল্যান, ডিজাইন প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগত মান বজায় রাখা হয়নি বলে অভিযোগ উপকারভোগীদের।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, বালু মিশ্রণের কথা রয়েছে এক বস্তা সিমেন্টের সাথে ৬ টুকরি। কিন্তু কুলাউড়ায় চলমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর কাজে এক বস্তা সিমেন্টের সাথে ২০ টুকরি বালু মিশিয়ে কাজ করেছে মিস্ত্রি। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো অপদস্থ হতে হয়েছে উপকারভোগীকে। এতে ফেটে গেছে খুঁটি, ঘর ও বারান্দার ফ্লোর। ফলে ঘরের টেকসই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। ল্যাট্রিন নির্মাণে ৮টি করে রিং স্লাব ব্যবহারের কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে ৫-৬টি করে রিং-স্লাব।
প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসন থেকে নিয়োগ দেয়া হয় ইউএনওর পছন্দের ঠিকাদার। নিয়োগকৃত রাজমিস্ত্রি ও কাঠমিস্ত্রিরা ইচ্ছে মতো কাজ করছেন। উপকারভোগীদের সাথে খারাপ আচরণ করেছেন।
দরজা-জানালা তৈরিতে শাল, গর্জন, জামরুল, কড়াই, শিশু, আকাশমণি গাছের কাঠ ব্যবহারের কথা থাকলেও অল্প বয়সী ও অসার ইউক্যালিপটাস কাঠ দিয়ে তড়িঘড়ি কাজ করছেন।
সরজমিন গেলে দেখা যায়, ঘর ও বারান্দার মেঝে সিসি ঢালাই ৩ ইঞ্চি ধরা থাকলেও ১-২ ইঞ্চি দিয়ে ঘরের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। পিএল এর ইটের গাথুনি ১ফুট ৯ ইঞ্চি করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে করা হচ্ছে ১ ফুট এবং ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ইট ও খোয়া।
সিডিউলে ১৭৫ বর্গফুট আয়তনের একটি ঘরে ৪ বর্গ ইঞ্চি ১২টি পিলারের উচ্চতা ১২ ফুট। মূল ঘর ও বারান্দা এবং ল্যাট্টিনে ৯টি খুঁটি ১০ ফুট ৬ মিলি ৪টি করে রড দেয়ার নিয়ম থাকলেও ১২টি পিলার ১০ ফুট করে এবং ৯টি পিলার ৮ ফুট করে ৬ মিলি. রডের স্থলে ৪ মিলি. ৩টি করে রড এবং রিং ৪ মিলি. রডের পরিবর্তে মোটা তার ও নিন্মমানের ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে।
পিলারে থাকবে ছয় এমএম গ্রেড রড (চারটি)। কিন্তু নন-গ্রেড রড ব্যবহার করা হচ্ছে। পিলালের রড বাঁধাইয়ে রিং (চুড়ি) হিসেবে রডের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ৮ নম্বর জিআই তার। তৃতীয় শ্রেণির ইটের খোয়া (ডাস্টসহ) দিয়ে পিলার বানানো হচ্ছে। পিলার ঢালাই শেষে চটের মাধ্যমে ১৪ থেকে ২১ দিন পানি দেয়ার (কিউরিং) কথা। কিন্তু সেখানে চটের বস্তা ব্যবহার করা হয়নি, দেওয়া হয়নি ঠিকমত পানিও। প্রতি ফুটে একটি করে রিং দেয়ার কথা থাকলেও ১৬ ইঞ্চি পর পর লাগানো হয়েছে রিং।
কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের কানাইটিকর গ্রামের রব উল্লাহ (৬৫) প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই ঘর কয়দিন টিকবো আল্লায় জানইন।
একই ইউনিয়নের সুজাপুর গ্রামের রুমেনা বেগম (৩০) জানান, ঘরটা বানাইতে অত খারাপ কাম করছইন, একজরা বাতাস দিলেই লড়ে (নড়ে)। গনিপুর গ্রামের আব্বাস আলী ও আব্দুল আহাদ জানান, মাত্র এক মাসের মধ্যে ঘরের নিচ (ফ্লোর) ফেটে গেছে। যারা কাজ করছে তারা ২০ টুকরি বালির সাথে এক বস্তা সিমেন্ট দিছে। এর লাগি এই অবস্থা।
পৃথিমাপাশা ইউনিয়নের গনিপুর গ্রামের পাকাঘর নির্মাণ শ্রমিক আজহারুল ইসলাম জানান, আমি নিজে এসব কাজ করি। কিন্তু আমারে যে ঘরটা দেয়া অইছে তা এক্কেবারে নিম্নমানের। এক লাখ টাকাতো দুরের কথা এসব ঘর নির্মাণে ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও বেশি হবে।
উপজেলায় মোট ৩০০ ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সরকার প্রতিটি কাঁচা ঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ঘর নির্মাণ শেষে বাড়তি টাকা সুবিধাভোগীদের ফেরত দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি এ টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার রাজিব মন্ডলের মুঠোফোনে কথা বলতে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই সংযোগ কেটে দেন।
এ বিষয়ে জানতে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল লাইছ এর মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ণ প্রকল্প-২ প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন (অতিরিক্ত সচিব) সাংবাদিকদের জানান,অনিয়মের এ বিষয়টি ইতোমধ্যে আমাদের নজরে এসেছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রকল্পের কাজের গুণগত মান সর্ম্পকে রিপোর্ট দিতে। এর পরেই আমাদের টিম কুলাউড়া পরিদর্শন করবে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে। খোঁজ খবর নিয়ে রিপোর্ট দিবো, কিন্তু একটু সময় লাগবে।
Posted ৪:৩৬ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০১৯
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.