
শ্রীমঙ্গল সংবাদদাতা,সংবাদমেইল২৪.কমঃ | বৃহস্পতিবার, ০৩ নভেম্বর ২০১৬ | প্রিন্ট
ভরা বর্ষা চলে গেলেও হাওর এর বুকে থই থই করছে ঘোলা পানি। কচুরিপানার জঙ্গলে উঁকি দিচ্ছে কলমি লতা। নাম না জানা গুল্ম-লতার ঝোপও কিছু চোখে পড়লো। ফাঁকে ফাঁকে হাঁটু সমান ঘাস বন। বলা হয়ে থাকে, এই হাওরের ঘাঁস খেলে দেড় গুণ বেশি দুধ দেয় গরু মহিষ। আশপাশের এলাকায় তাই ব্যাপক চাহিদা এখানকার ঘাসের। এক সময় এরকম সাড়ে তিন শতাধিক ছড়া মিশতো হাইল হাওরে। এখন বড়জোর অর্ধশত ছড়া প্রবাহ পায় বর্ষায়। মজে গেছে বাকিগুলো। কোথাওবা ছড়ার বুকে গড়ে উঠেছে মৌসুমী শস্য ক্ষেত।
এই হাওরের পানির প্রধান উৎস এখন গোপলা নদী। উজানে বিলাসছড়া থেকে বেরিয়ে হাওর চিরে এই নদী ভাটিতে বিজনা নদী হয়ে মিলেছে মেঘনার উপরের অংশে কুশিয়ারা মোহনায়। ১৮২৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজারের কালিয়ারগাঁও পর্যন্ত নিন্মাঞ্চল ডেবে গিয়ে নাকি এই হাওরের সৃষ্টি। আঙুল তুলে জলের ভেতর ফেলে রাখা কারেন্ট জালের ভাসমান ফাতা দেখালো মাঝি। হাত বাড়ালেই শাপলা-শালুক, পদ্মখোঁচা, ভেট আর মাখনা। নৌকার গতি না কমিয়েই ভেট তোলা যাচ্ছে অনায়াসে। আর দু’এক মাস পর দু’হাজার টাকা মন দরে বিকোবে এই জলজ ভেট।
পানিফলগুলোও কেবল দানা বাঁধছে। এই কচি অবস্থাতেই এগুলো যতো মিষ্টি পেকে গেলে খেতে কতো সুস্বাদু হবে কে জানে। সামনে পানির ওপরে মাথা তুলে থাকা এক খন্ড ভূমির পুরোটা জুড়েই বাঁশঝাড়। পেছনে পানির ভেতর চুপটি করে বসে বেয়াড়া বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে একটা ঝাঁকড়া কড়চ গাছ। এদিক ওদিক কিছু পাখি উড়ছে বটে, কিন্তু হাইল হাওরের চিরায়ত দৃশ্যের তুলনায় তা কিছুই নয়। বিরল প্রজাতির নীল পদ্ম এখন কদাচিৎ চোখে পড়ে। শাপলা-শালুকের উৎপাদনও কমে এসেছে অনেকটাই। তবু এখনো এই হাওর জলজ সম্পদের অফুরন্ত ভান্ডার হয়ে আছে। জলের নিচে আপন সুখে ভাসছে জলজ আগাছা।
এই হাইল হাওরকে বলা হতো বৃহত্তর সিলেটের মৎস্য ভান্ডার। পাখি দর্শনেরও স্বর্গরাজ্য বলা হতো এই জলাশয়কে। পাওয়া যেতো ৯৮ প্রজাতির দেশি মাছ, ১৬০ প্রজাতির পাখি। এ হাওরের অন্যতম আকর্ষণ কুড়া পাখি। শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া, তিব্বত, চীন ও হিমালয় থেকে অতিথি পাখি আসে এখানে। হাওরজুড়ে তখন বসে বকের মেলা, আপনমনে খেলে বেড়ায় পানকৌড়ির ঝাঁক। শিকারের পেছনে লেগে থাকে ভুবন আর শঙ্খচিল। জলময়ূর খেলে বেড়ায় পদ্মবনে।
তবে মৌলভীবাজার জেলার অন্তত ৫ ডজন চা-বাগানের বিষাক্ত কীটনাশক বৃষ্টিতে ধুয়ে এসে ঘাতক হচ্ছে এই পাখি ও মাছের। অতিলোভী মৎস্য শিকারীরাও কারেন্ট জালে ধ্বংস করছে মাছ ও জলজ জীবন। এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে নাপিত কই, রানী, নাফতানি, তারা বাইন, বাছা, ঘারুয়া, ছেপচালা, একখুটি, চাকা, বাঘাইর, ঢেলা, রিটা, বাঁশপাতা, বামোশ, বড় বাইন, তিতপুঁটি, নামা চান্দা, শ্বেত সিংগি, শ্বেতমাগুর মাছ। বিলুপ্তির দিন গুনছে গজার, গুলশা, দাড়কিনি, পাবদা, আইড়, বেদা, মিনি, ফলি, চিতল, টাটকিনি মাছ। যদিও এখনো বছরে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয় হাইল হাওরে। বর্ষায় পানি বেড়ে গেলে এই হাওর প্রসারিত হয়ে পড়ে ১৪ হাজার হেক্টর এলাকায়। আর শুকনো মৌসুমে বিস্তৃতি থাকে ৪ হাজার হেক্টর। তবে গড় হিসেবে হাইল হাওরের আয়তন ১০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ৪ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি, ৪,৫১৭ হেক্টর হাওর, ১৪শ” হেক্টর বিল, ৪০ হেক্টর খাল আর ৫০ হেক্টর নদী। এ হাওরে বিলের সংখ্যা ৩শ’এরও ওপরে। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার কিছু অংশ জুড়ে থাকলেও এই হাওরের পরিচিত মূলত শ্রীমঙ্গলের হাওর হিসেবে।
সংবাদমেইল২৪.কম/বাঅ/নাশ
Posted ৬:৫৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ নভেম্বর ২০১৬
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.