মঙ্গলবার ১৯ মার্চ, ২০২৪ | ৫ চৈত্র, ১৪৩০

প্রসঙ্গঃ ফ্রান্সের নির্বাচন

আব্দুল ওয়াদুদ ময়নুল, অতিথি লেখক,সংবাদমেইল২৪.কম: | রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | প্রিন্ট  

প্রসঙ্গঃ ফ্রান্সের নির্বাচন

ফটো: লেখক আব্দুল ওয়াদুদ ময়নুল

শিল্প ও সংস্কৃতির দেশ ফ্রান্স বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রের একটি। একসময় আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্রান্সের আধিপত্য বিস্তার ছিল। ফ্রান্সের ইতিহাস-ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস কম বেশ সবারই জানা। ফ্রান্সকে বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবাধিকারের দেশ বলা হয়। বিশ্বের ৭০টি দেশের সর্বমোট ২০০ মিলিয়ন লোক ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারে।
ফ্রান্স জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি। এই স্থায়ী সদস্যরা নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন, নতুন সদস্য দেশ অন্তর্ভুক্তি বা মহাসচিব প্রার্থীর নিয়োগে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে। পর্যটনের জন্য ফ্রান্স বিশ্ব বিখ্যাত। দেশটির আয়ের সিংহভাগ আসে পর্যটন খ্যাত থেকে। বৈমানিক যন্ত্রপাতি রপ্তানিতে ফ্রান্স বিশ্বে প্রথম। প্যারিসে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর বিমান বিক্রির হাটও বসে।
ফ্রান্সই প্রথম বিশ্বকে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উপহার দেয়। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বহু প্রজন্ম ধরে বিশ্বের অন্যত্র অনেক সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলন ঘটে। অতএব এ কথা বলাই বাহুল্য যে, ফ্রান্সের জাতিয় নির্বাচন বিশ্বে অনেক প্রভাব ফেলতে সক্ষম ।
ফ্রান্সের বর্তমান সংবিধান হচ্ছে “পঞ্চম ফরাসি প্রজাতন্ত্র”। আগামী ২৩ এপ্রিল ও ৭ মে ফ্রান্সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে মোট ৪৪ জন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। মোট ৪ জন প্রার্থী ইতিমধ্যেই আলোচনা-সমালোচনায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় উঠে এসেছে। এদের মধ্যেই যে কারো মাথায় প্রেসিডেন্ট মুকুট উঠার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে জনমত জরিপে এখন পর্যন্ত যে চারজন প্রার্থী এগিয়ে:
Marine le pen (মারিন লো পেন) : কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ” Front national” (ফ্রন্ট ন্যাশনাল) এর পার্থী “লো পেন” জনমত জরিপে এখন পর্যন্ত সবার উপরে রয়েছে। এই দলের মুল নীতি-ই হচ্ছে- ষধ ভৎধহপব ঢ়ড়ঁৎ ষবং ভৎধহম্ফধরংব অর্থাৎ ফ্রান্স শুধুই ফরাসিদের জন্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অভিবাসীদের উপর করাত চালাতে অর্ধশতাধিক অঙ্গীকার করেছেন ‘ফরাসি ট্রাম্প’ খ্যাত ডানপন্থী নেতা লো পেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী “লো পেন” আন্তর্জাতিক বানিজ্যের ক্ষেত্রেও ট্রাম্পকে অনুসরণ করবেন বলে প্রচারণায় জানিয়েছেন।
নিজেকে ‘জনগণের প্রার্থী’ উল্লেখ করে পেন দেশকে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের অঙ্গীকার করে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকার’ মতো শ্লোগান হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ‘মেইড ইন ফ্রান্স’। ৪৮ বছর বয়োসী পেন বলেন, ‘জনগণের প্রার্থী’ হিসেবে তিনি তার নিজের সীমানা পাহারার জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষা, ব্যবসার জন্য নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন করবেন। এছাড়া একটি মজবুত রাষ্ট্রের জন্য অভিবাসন, উদ্বাস্তু ও বিশ্বায়নের বিষয়টি অবমুক্ত রাখবেন না। লো পেনের মতে, ‘ফ্রান্স সর্বগগ্রাসী জোড়া হুমকির সম্মুখীন: একটি অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও অপরটি ‘ইসলামী মৌলবাদ’।
আল-জাজিরার স্থানীয় প্রতিনিধি নাতাশা বাটলার জানান, পেন জনগণকে এই বার্তা দিতে চান যে বিশ্বায়ন ও অভিবাসন ফ্রান্সকে ধ্বংস করছে। সুতরাং এই অবস্থায় ফ্রান্সের জন্য সঠিক লোক তিনিই।
মারিন লো পেনের দল গত দুই চার বছর আগেই তেমন জনপ্রিয় ছিলনা। ফ্রান্সে গত দুই বছরে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার পর তার দলের উপর ফরাসিদের আস্থা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এবং সে ক্ষমতাসীন হলে অভিবাসী ও ইসলাম ধর্মাবলাম্বীদের উপর কঠোর নীতি বাস্তবায়ন হবে তা কিন্তু নিশ্চিত।
Emmaunuel Macron ( ইমানুয়েল মাকরো): মাত্র ৩৯ বছর বয়সী মাকরো- ২০১৪-২০১৬ তে বর্তমান ওলাদ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ৬ এপ্রিল ২০১৬ তে নতুন রাজনৈতিক দল “En marché” (অন মারসি) প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছেন।
সামাজিক উদারনীতি, জাতীয়তাবাদ, ফ্রান্সে বিবাদমান ডান ও বামপন্থীদের মধ্যে ঐতিহ্যগত দ্বন্দ্ব মেটানো এবং ফ্রান্সকে বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যুক্তি নির্ভর বক্তব্য ও দূরদর্শিতার জন্য এই তরুণ উদীয়মান নেতা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। জনমত জরিপে এখন পর্যন্ত তার অবস্থান দ্বিতীয়।
François Fillon (ফ্রসোয়া ফিলন): সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির দল- “UMP” (Union pour un mouvement populaire) থেকে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পেলেন সারকোজি সময়কার দেশের প্রধানমন্ত্রী ফ্রসোয়া ফিলন। তবে এই বার দলটির নাম পরিবর্তন করে “Les républicains” (রিপাবলিকান) রাখা হয়েছে।
ডানপন্থী দলের নেতা ফিলন তার নির্বাচনী প্রচারণায় সমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ফ্রান্স সত্য জানতে চায় এবং সমস্যার প্রতিকার চায়। দলটি এবার জয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জনমত জরিপে এখনো তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।


Benoît Hamon (বেনোয়া হামন): ফ্রান্সের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন “Parti socialiste” (সোশ্যালিস্ট পার্টি)র হয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বেনোয়া হামন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওলাদেরও পূর্ণ আস্থা রয়েছে হামনের উপর।
১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সোসালিষ্ট পার্টি মূল বামপন্থী রাজনৈতিক দল। একমাত্র এই দলটি অভিবাসীদেরকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছে। ফ্রান্সে বসবাসরত প্রত্যেক বিদেশীই চায় এই দলটি ক্ষমতায় আসুক। এই সরকারের সময়ে ফ্রান্সে অভিবাসন নীতি, শরণার্থীদের আশ্রয় দানসহ অভিবাসীদের সুযোগ সুবিধা প্রদানে প্রশংসাযোগ্য।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে,এইবার দলটির গ্রহণযোগ্যতা ফরাসিদের কাছে নেই বললেই চলে। সমকামী বিবাহ আইন পাশ, অভিবাসীদের সুযোগ সুবিধা প্রদানসহ ফ্রান্সে পাশাপাশি কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা দলটিকে তলানিতে পৌছিয়েছে। উপরের তিনজন প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হলেও ক্ষমতাসীন দলের যে পরাজয় নিশ্চিত তা হলফ করে বলা যায়।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রবাসী সকলের ভেতরেই একটি আতংক বিরাজ করছে। এখানে বসবাসরত অসংখ্য বাংলাদেশীর ভাষ্য যে, মারিন লো পেন ক্ষমতায় আসলে ফ্রান্স থেকে অভিবাসীদের যেতে বাধ্য করা হবে কিংবা ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বন্ধ করা হবে বা মুসলিমদের তাড়িয়ে দেওয়াহবে!
কথাটা হাস্যকর। আসলে সবই হচ্ছে রাজনৈতিক কলা কৌশল। পৃথিবীর সকল অভিনয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অভিনয় হচ্ছে রাজনীতি। সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে মসনদ পরিবর্তন হলেও ফ্রান্সের মূলনীতি- liberté, Égalité, fraternité et laïcité (স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার) এর ওপর হাত দেওয়ার অধিকার কারো নেই। আর এমনটা হলে ফ্রান্স মূলত গৃহযুদ্ধের দিকে যাওয়ার আশঙ্কাই করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে সরকার পরিবর্তন হলে যে যে ক্ষেত্রে কিছুটা কঠোর হতে পারে- রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে দেশে তদন্ত করা (জার্মান, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডের অনুকরণে), ফরাসী ন্যাশনালিটি আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে (তথা পাঁচ বছরের স্থলে দশ বছর) ফ্রান্সে বসবাস করা, allocation chomage/CAF/assedic (বয়স্ক বা বেকারভাতা) এর সময়সীমা নির্ধারণ করা, পরিবার নিয়ে আসার ব্যাপারে আরো কিছু নিয়মনীতি যোগ হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক।
তবে ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশীসহ সকল দেশের প্রবাসীরা চাচ্ছেন, Parti socialiste ( সমাজতান্ত্রিক দলের) প্রার্থী “Benoît Hamon” জয় করুক। তবে এখন অপেক্ষা ছাড়া কিছু নেই। দেখা যাক, দুটো মাস পরে কে হতে পারে ফ্রান্সের স্বপ্নদ্রষ্টা! এখন বিশ্বে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেই আছে, তা থেকে কিছুটা অনুমান করাই যাচ্ছে…।

সংবাদমেইল২৪.কম/অতিথি লেখক/ প্রাবন্ধিক। ফ্রান্স প্রবাসী।


Facebook Comments Box


Comments

comments

advertisement

Posted ২:২৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সংবাদমেইল |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত