মঙ্গলবার ১৯ মার্চ, ২০২৪ | ৫ চৈত্র, ১৪৩০

পুলিশ জাদুঘরে গৌরবের অনন্য ইতিহাস

অনলাইন ডেস্ক : | রবিবার, ১২ মার্চ ২০১৭ | প্রিন্ট  

পুলিশ জাদুঘরে গৌরবের অনন্য ইতিহাস

রাজধানীর রাজারবাগের পুলিশ অডিটরিয়াম ভবন বাঁয়ে রেখে একটু এগোলেই চোখে পড়ে নান্দনিক এক স্থাপনা। এ ভবনে ঢুকতেই শ্রদ্ধায় নত হবেন যে কেউই। সারি সারি সাজানো মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহামূল্যবান হাজারো স্মারক, দেয়ালজুড়ে বাঁধাই করা সম্মুখ সমরের দুর্লভ চিত্র। ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ এটি। জাদুঘরটির নানা স্মারক সাক্ষ্য দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অজানা অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের। এ জাদুঘর যেন ‘ইতিহাসের এক জীবন্ত ঘর’।

বঙ্গবন্ধু গ্যালারি দিয়ে শুরু: গত ৭ মার্চ দুপুরে মূল গেট থেকে ১০ টাকায় টিকিট কেটে জাদুঘরের গেটে যেতেই খুলে গেল স্বয়ংক্রিয় কাচের দরজা। ভেতরে ঢুকেই বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। দুর্লভ সব ছবি আর পোস্টারে পরিপাটি সাজানো পুরো গ্যালারি। দেয়ালে দেয়ালে নানা তথ্যচিত্র। গ্যালারি ঘুরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যই মিলবে। এক পাশে রয়েছে অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার। সেখানে বাজছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আর ১৯৭৫ সালে প্রথম পুলিশ সপ্তাহে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা। অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টারের পাশেই জাদুঘরের লাইব্রেরি। আলমারিতে থরে থরে সাজানো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা বই। লাইব্রেরির অন্য কক্ষে সাজানো সুভেনির কর্নারে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নানা প্রকাশনা ও স্মারক সাজানো।


ভূগর্ভে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ‘জীবন্ত স্মারক‘: বঙ্গবন্ধু গ্যালারির মাঝখানে গোলাকার জায়গায় কারুকাজখচিত ভূগর্ভস্থ তলায় নামার সিঁড়ি। মূলত ভূগর্ভের এ তলাটার গ্যালারিতেই মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা স্মারক সাজানো। বাঁ দিক ধরে হাঁটা শুরু করলেই চোখে পড়বে ‘লেটার ডিস্ট্রিবিউশন বক্স’। চিঠি ও দলিল বিতরণের এ বাক্সটি ১৯৭১ সালে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
গ্যালারি ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে কাচের বাক্সে প্রায় দুই ফুট দৈর্ঘ্যের লোহার একটি দণ্ড। এটি পাগলা ঘণ্টা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের ঠিক আগে ঐতিহাসিক এই লৌহদণ্ড বাজিয়েই প্রতিরোধের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় থেকেই প্রথম প্রতিরোধ শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। এরপরই পুলিশ লাইন্স আক্রমণের খবর পাঠানো হয় কন্ট্রোল রুমে। সেই ওয়্যারলেস সেটও আছে গ্যালারিতে। গ্যালারির এক পাশে দুটি কাঠের বেঞ্চ দেখে হয়তো দর্শনার্থী একটু অবাকই হবেন। এ দুটি ‘স্মৃতির বেঞ্চ’। জাদুঘরে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালনকারী এএসআই শহীদুল ইসলাম জানালেন, প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত দুই পুলিশ সদস্যকে মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে কোনো শয্যা না পেয়ে তাদের দু’জনকে এই দুটি বেঞ্চে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। বেঞ্চেই শহীদ হন পুলিশের দুই সদস্য। সাজানো আছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ব্যবহার করা পুলিশের ঐতিহাসিক সেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল।
দেয়ালজুড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশবীরদের ব্যবহৃত রাইফেল, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, ইউনিফর্ম, চশমা, মানিব্যাগ ও সার্চলাইট সাজানো। গ্যালারিতে আছে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের ব্যবহৃত রেডিও ও ডায়েরি। শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তখনকার ডিআইজি (পরে প্রথম আইজিপি ও স্বরাষ্ট্র সচিব) আবদুল খালেক বাঙালি পুলিশ সদস্যের প্রতি এক খোলা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সন্তান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। … তোমরা চাকরি ছেড়ে চলে আসো দেশমাতৃকার জন্য।’ তিন পাতার সেই খোলা চিঠিও ঠাঁই পেয়েছে দেয়ালে।
রাবেয়ার ভাষ্যে চোখের পানি ঝরে: ১৯৭১ সালে রাজারবাগে পরিচ্ছন্নকর্মী ছিলেন রাবেয়া নামে এক নারী। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি বাহিনী তার ওপর চালিয়েছিল বর্বর পাশবিক নির্যাতন। তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে বন্দি অবস্থায় থেকে নয় মাস ধরে প্রত্যক্ষ করেছেন রাজারবাগে ধরে আনা নারীদের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস ও বর্বর নির্যাতনের দৃশ্য। সে সব করুণ কথা রাবেয়ার ভাষ্যে লেখা রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে। রাবেয়ার হুবহু ভাষ্য স্থান পেয়েছে জাদুঘরের গ্যালারিতে।
জাদুঘর তৈরির পেছনের কথা: পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (সংস্থাপন) হাবিবুর রহমান ২০০১ সালে রাজারবাগে কর্মরত ছিলেন সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে। সেখানে বসে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের নানা অবদানের টুকরো টুকরো তথ্য পান তিনি। পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির কথা ভেবে তিনি কাজ শুরু করলেও নানা বাধা-বিপত্তিতে এরপর চলে যায় আরও ৮ বছর। ২০০৯ সালে তিনি যখন ডিএমপির ডিসি (সদর); তখন মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ইতিহাস ধরে রাখার কাজটা এগিয়ে নেন আরও। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার (বর্তমানে আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক এগিয়ে আসেন এ কাজে। ২০১৩ সালে ছোট্ট পরিসরে শুরু হয় জাদুঘরের কার্যক্রম। শুরু থেকেই পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি আবিদা সুলতানাও রয়েছেন এ জাদুঘর তৈরির নেপথ্যে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ হাজার বর্গফুটের একটি নান্দনিক ভবনে এ জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। দৃষ্টিকাড়া এ ভবনের স্থপতি মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডার মীর আল আমিন।
অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান গর্ব করেই বলছিলেন, পৃথিবীতে হয়তো পুলিশ জাদুঘর রয়েছে। তবে বাংলাদেশেই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রয়েছে। এটি এখন কেবল পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নয়; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বা মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ বড় গবেষণা কেন্দ্র।
খোলা থাকে সপ্তাহে ৬ দিন: বুধবার বন্ধ থাকে এ জাদুঘর। এ ছাড়া সপ্তাহের অন্য ছয়দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বেলা ১টা থেকে এক ঘণ্টার বিরতি। সবার জন্য উন্মুক্ত এই জাদুঘর প্রবেশ টিকিটের মূল্য ১০ টাকা।

সূত্র: সমকাল/আতাউর রহমান


Facebook Comments Box


Comments

comments

advertisement

Posted ১২:৩৮ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১২ মার্চ ২০১৭

সংবাদমেইল |

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. মানজুরুল হক

নির্বাহী সম্পাদক: মো. নাজমুল ইসলাম

বার্তা সম্পাদক : শরিফ আহমেদ

কার্যালয়
উপজেলা রোড, কুলাউড়া, মেলভীবাজার।
মোবাইল: ০১৭১৩৮০৫৭১৯
ই-মেইল: sangbadmail2021@gmail.com

sangbadmail@2016 কপিরাইটের সকল স্বত্ব সংরক্ষিত