মাওলানা মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান | রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০১৭ | প্রিন্ট
দশই মহররম মুসলিম জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনা ও শোকের একটি দিন। এ দিনে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, বেহেশতি যুবকদের সরদার হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) যালিম ইয়াযযিদ বাহিনীর হাতে কারবালার মরুপ্রান্তরে নির্মমভাবে সপরিবারে শহীদ হন। তাঁর এ শাহাদাত ছিল ইসলামের প্রকৃত আদর্শের পক্ষে আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত। হযরত হোসাইন (রা.) অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য এক মহান শিক্ষা রেখে গেছেন।
কারবালার ঘটনা প্রবাহ
হযরত আমীর মু‘আবিয়া (রা.) এর ইন্তিকালের পর তদীয় পুত্র ইয়াযীদ খিলাফতের মসনদে আসীন হয়। ইয়াযীদ ছিল দুষ্ট প্রকৃতির, দুরাচারী লোক। তাই হযরত হোসাইন (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রা.)-এর মত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তার হাতে বায়আত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় কূফার কিছু লোক হযরত হোসাইন (রা.) কে কূফায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালো এবং তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণের অঙ্গীকার করল। পর পর কয়েকটি আমন্ত্রণ পত্র (প্রায় দেড়শ চিঠি) পেয়ে পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য হোসাইন (রা.) স্বীয় চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীল (রা.) কে কুফায় প্রেরণ করলেন। মুসলিম ইবনে আকীল ইতিবাচক অবস্থা অনুধাবন করে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)কে কুফায় তাশরীফ আনার জন্য পত্র লিখলেন। কেননা শুধুমাত্র কুফাতেই হোসাইন (রা.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর নিকট আঠার হাজার লোক বায়আত গ্রহণ করেছিল। মুসলিম ইবনে আকীলের পত্র পেয়ে হোসাইন (রা.) কুফার পথে রওয়ানা হলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, উমর ইবনে আব্দুর রহমানসহ অনেক হিতাকাক্সক্ষীর উপদেশ-অনুরোধ তিনি এক্ষেত্রে রক্ষা না করে ইসলামী খিলাফতকে দূরাচারীর হাত থেকে রক্ষার জন্য তার সফর কর্মসূচী শুরু করলেন। কিন্তু ভাগ্যের বিপাকে এরই মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল। ইয়াযিদ বাহিনী মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যার জন্য অভিযান পরিচালনা করল। মুহাম্মদ বিন আশআছের নেতৃত্বে সত্তর জন সৈন্যের বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ করে আহত হলেন হযরত মুসলিম। পরবর্তীতে ইবনে যিয়াদের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হলো। শাহাদতের পূর্বে মুসলিম ইবনে আকীল-এর কৃত অসীয়ত মুতাবিক মুহাম্মদ ইবনে আশআছ হযরত হোসাইন (রা.)-এর নিকট কুফা আগমন না করার জন্য সংবাদ পাঠালো। একই সাথে মুসলিম ইবনে আকীলের শাহাদতের সংবাদও তাঁর নিকট পৌঁছল। এ সংবাদের প্রেক্ষিতে মুসলিমের গোত্রের সবাই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শপথ নিলে কুফায় যাওয়া ছাড়া হোসাইন (রা.)-এর সামনে আর কোন পথ খোলা থাকলো না। হযরত হোসাইন (রা.) স্বীয় সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে অগ্রসর হয়ে কারবালা প্রান্তরে উপনীত হলেন।
৬১ হিজরীর ১০ই মুহররম। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)। বিশাল সেনাবাহিনী কিংবা যুদ্ধের প্রস্তুতি কোনটিই নেই। নেই প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র। সাথে আছে কেবল আল্লাহর রাহে নিবেদিত ৭২জন সদস্যের ক্ষুদ্র কাফেলা। প্রথমদিকে হযরত হোসাইন (রা.) যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চাইলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন- তোমরা আমাকে মক্কা মুর্কারামা ফিরে যেতে দাও অথবা বুঝাপড়ার জন্য ইয়াযিদের নিকট যেতে দাও, নতুবা দেশের যে কোন এক সীমান্তে চলে যেতে দাও। কিন্তু ইয়াযীদ সৈন্যরা কোন প্রস্তাবেই রাজী না হলে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তিনি তাদের উদ্দ্যেশে এক হৃদয়বিদারক ভাষণ দিলেন। কাফেলার অন্যতম সদস্য হযরত জুহায়র ইবনে কায়েস (রা.) অগ্রসর হয়ে আহলে বায়তকে হত্যা থেকে বিরত থাকার জন্য ইয়াজিদ বাহিনীর প্রতি আহবান জানালেন। কিন্তু কোন আহবানেই তাদের মন পরিবর্তন হল না। এমতাবস্থায় পাপীষ্ট সীমার তীর নিক্ষেপ করে যুদ্ধের সূচনা করল । তখন ইয়াযীদ বাহিনীর একাংশের সেনাধ্যক্ষ হুর বিন ইয়াযীদ অনুতপ্ত হয়ে হোসাইন (রা.)-এর দলে শামিল হলে তার প্রতিও তীর নিক্ষেপ শুরু হলো। তুমুল যুদ্ধে হযরত হোসাইন (রা.)-এর সাথীদের অধিকাংশই শহীদী সুরা পান করলেন। শহীদ হলেন শিশু আলী আসগর। পাপীষ্টরা তার লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলল। হযরত হোসাইন (রা.) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বললেন, ‘আল্লাহ এ জাতিকে ধংস করুন যারা তোমাকে শহীদ করেছে। এরা আল্লাহর মীমাংসায় কেমন মূর্খতা দেখালো। তুমি ছাড়া পুত্র জীবনের কোন প্রয়োজন নেই।’ তিনি লাশ তুলে তাবুতে নিয়ে এলেন। এদিকে উমর ইবনে সা’দ-এর তরবারির আঘাতে কাসিম বিন হাসান (রা.) আহত হয়ে পড়ে গেলেন। তার মুখ থেকে বের হল হে চাচা! হযরত হোসাইন (রা.) দৌড়ে এসে তাকে ধরলেন এবং উমরের উপর তরবারি দ্বারা আক্রমণ করলেন। তার হাত কনুই পর্যন্ত কেটে দিলেন। হযরত হোসাইন (রা.) ভাতিজা কাসিম (রা.) এর লাশ কাধেঁ উঠিয়ে নিয়ে এসে স্বীয় আহলে বায়ত ও অন্যদের পাশে শুইয়ে রাখলেন।
শিশু ও মহিলারা ছাড়া কাফেলার প্রায় সকলেই একে একে শহীদ হয়ে গেছেন। হযরত হোসাইন (রা.) বন্ধুবান্ধবহীন একা ময়দানে দাড়িয়ে রইলেন। তিনি একা হলেও তার সামনে আসার সাহস শত্রুদের কারো হচ্ছিল না। বহুক্ষণ পর্যন্ত নিরবেই কাটল। একের পর এক অনেকে তার সামনে এসে নীরবে ফিরে গেল। হযরত হোসাইন (রা.)- কে হত্যার সাহস কেউ দেখাল না। হত্যার পাপ কেউই নিজের কাঁধে বহন করতে চাইল না। অবশেষে পাপীষ্ট মালিক ইবনে নাছির সম্মুখে অগ্রসর হলো এবং হযরত হোসাইন (রা.)-এর উপর তরবারি দ্বারা আক্রমন চালাল। তিনি মারাত্মক আহত হলেন। এমতাবস্থায় স্বীয় ছোট ছেলে আব্দুল্লাহকে ডেকে নিজের কোলে বসালেন। ইবনে আসদী নামক এক দুর্ভাগা তাকেও তীর মেরে শহীদ করে দিল। হযরত হোসাইন (রা.) এই নিস্পাপ বাচ্চার রক্ত হাতে নিয়ে মাটিতে ছিটিয়ে দিলেন এবং দু’আ করলেন, হে আল্লাহ তুমি নিজে এ যালিম লোকদের থেকে প্রতিশোধ নিও।
সত্য-ন্যায়, বীরত্ব ও সৎ-সাহসের প্রতীক হযরত হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে একা, পিপাসায় অত্যন্ত কাতর। পানির জন্য অগ্রসর হলেন ফুরাত নদীর দিকে। কিন্তু পাপীষ্টরা তাকে পানি পান করতে দিল না। নির্মম হাসিন বিন নমির তার পবিত্র মুখ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করল। তীর হযরত হোসাইন (রা.) এর মুখে আঘাত হানল, প্রচুর রক্তপাত হল। অতঃপর সীমার দশজন সৈন্যসহ হযরত হোসাইন (রা.)-এর দিকে অগ্রসর হলো। তিনি অত্যন্ত পিপাসার্ত ও মারাত্মক আহত হওয়া সত্ত্বেও বীরত্বের সাথে তাদের মুকাবিলা করছিলেন। তিনি যে দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন শত্রুরা সেদিক থেকে পালাচ্ছিল। সীমার তখন সকলকে এক যুগে আক্রমণ করার জন্য নির্দেশ দিল। তার আদেশ পেয়ে পাপীষ্ট দুর্ভাগারা অগ্রসর হলো এবং নেজা-বল্লম ও তরবারী দ্বারা এক সাথে হামলা করল। এতে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় বংশধর, বেহেশতী যুবকদের অন্যতম সরদার হযরত হোসাইন (রা.) শাহাদতবরণ করলেন। সীমার খাওলা বিন ইয়াযিদকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দিল। সে অগ্রসর হতে চাইলে তার হাত কেঁপে উঠল। ফলে সে আর এগুলো না। অবশেষে সুনান বিন আনস-ই এ পবিত্র দেহ থেকে মাথা মুবারক বিচ্ছিন্ন করল। শাহাদাতের পর হযরত হোসাইন (রা.)-এর শরীরে তেত্রিশটি নেজার আঘাত, চৌত্রিশটি তরবারীর আঘাত এবং অসংখ্য তীরের আঘাত দেখা গিয়েছিল।
হযরত হোসাইন (রা.) নির্মমভাবে যালিমের হাতে শাহাদত বরণ করলেন ঠিকই, কিন্তু রেখে গেলেন এক অনুপম আদর্শ। সে আদর্শ যালিমের বিরুদ্ধে মযলুমের মাথা তুলে দাঁড়াবার, ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে জীবনকে বিলিয়ে দেবার। হোসাইন (রা.) এর শাহাদত নিছক শোকের নয় বরং ত্যাগের এক অনুপম শিক্ষা। তাই তার শাহাদত দিবসে শোক পালন কিংবা মর্সিয়া গাওয়া নয়; বরং শপথ নিতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার, সত্যের পক্ষে জীবন কুরবানী করার।
আল্লাহ আমাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জীবন কুরবানী করার মানসিক শক্তি ও ক্ষমতা দান করুন।
____________________________আমীন।
Posted ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০১৭
সংবাদমেইল | Nazmul Islam
.
.